বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল?

(উত্তর) সূচনা : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ফলে বঙ্গপ্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী কয়েকবছরের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিভিন্ন কারণে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী মুক্তিযুদ্ধ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের ফলে পূর্ববঙ্গ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট হিসেবে বিভিন্ন ঘটনা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। এগুলি সংক্ষেপে উল্লিখিত হল –

  • স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পূর্ববঙ্গের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়।
  • পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের তীব্র রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে।
  • স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্যোগ বাঙালিরা ভালো চোখে দেখেনি। 
  • বাঙালি সত্তা ও বাংলা ভাষার জন্য পূর্ববঙ্গে শুরু হয় ১৯৫২-র ‘ভাষা আন্দোলন’। ছাত্রদের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে সূচিত হয় বাংলাদেশ গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ।

শেখ মুজিবর রহমান হলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা। তিনি বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপুর্ণ। 

আওয়ামি লিগের ভূমিকা : মুসলিম লিগ থেকে পৃথক হওয়া আওয়ামী লিগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আওয়ামি লিগ কয়েকটি ক্ষুদ্র দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করলেও পাক সরকার তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামি লিগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান আন্দোলন শুরু করলে শেখ মুজিব-সহ লিগের প্রধান কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে) অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ব্যাপক গণ-আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

সাধারণ নির্বাচন : ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১টি আসন পায়। এভাবে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে নতুন সংবিধান রচনার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে পরের বছরের মার্চ মাসে পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ববাংলার সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামি লিগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান ৭ মার্চ ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ২৫ মার্চ পাক সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু করলে শেখ মুজিবর তাঁর আগুন-ঝরা বক্তৃতায় বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, “তোমাদের যা যা কিছু আছে তা নিয়েই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ো। এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই।” 

২৬ মার্চ মুজিবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চে মুজিবরের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে বলে ধরা হয়। এই দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

গণহত্যা : স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে পূর্ববঙ্গের মানুষ শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সশস্ত্র পাক বাহিনী দীর্ঘ ২৬৭ দিন ধরে নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের গণহত্যার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে এটিই সবচেয়ে বড়ো গণহত্যা বলে মনে করা হয়। গণহত্যায় মোট নিহতের সংখ্যা ১০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। অন্তত ৪ লক্ষ বাঙালি নারী ধর্ষিতা হন।

প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা : পাক সরকার শীঘ্রই মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতা শেখ মুজিবরকে গ্রেপ্তার করে। ফলে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে। শেখ মুজিবর রহমান হন রাষ্ট্রপতি। এই সরকার ভারতের মাটি থেকে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকে।

ভারতের ভূমিকা

মুক্তিসংগ্রামের সময় পাক বাহিনী পূর্ববঙ্গে গণহত্যা চালালে পাক হামলা থেকে বাঁচতে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ভারত অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষের পাশে দাঁড়ান। 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পূর্ববঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে পাক বাহিনীকে পূর্ববঙ্গে কোণঠাসা করে ফেলে। আমেরিকা এবং চিনের সমর্থন না থাকলেও ভারত সরকার পিছু হটেনি। তবে ভারত ও বাংলাদেশকে সমর্থন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবশেষে ভারত ৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে প্রায় ৯০ হাজার পাক সেনাকে বন্দি করে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পূর্ববঙ্গের মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পাক সৈন্যবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী আকাশ থেকে ঢাকায় পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে প্রচারপত্র বিতরণ করে। এই প্রচারপত্রে ভারতীয়রা জানায় যে, সময় থাকতে পাক বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুক। শেষপর্যন্ত পাক বাহিনীর সেনাপ্রধান ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ খ্রি. ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-র কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন।

বাংলাদেশের বিজয়দিবস : ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পূর্ববঙ্গের মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাক সৈন্যবাহিনী শেষপর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

উপসংহার : বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য পূর্ববঙ্গে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা ক্রমে ভাষা আন্দোলনের সীমানা ছাড়িয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত