স্বাধীন ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো।

(উত্তর) পরিকল্পনা কমিশন : ভারতে দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় ব্রিটিশ শক্তি ভারতে সীমাহীন অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে এদেশকে নিঃস্ব করে দেয়। ফলে স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারত চরম আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই আর্থিক ব্যবস্থা চরম আকার ধারণ করে। আবার দেশভাগের ফলে এই সংকট আরও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া উদবাস্তু সমস্যার ফলে ভারতে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থান প্রভৃতির আরও অভাব দেখা দেয়। এভাবে ভারত এক গভীর অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়।

অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে শামিল করার উদ্দেশ্যে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সক্রিয় উদ্যোগ নেন। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন’ বা ‘যোজনা কমিশন’ গঠিত হয়। মিশ্র-অর্থনীতির দেশ ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ ঘুরে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। 

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : ১৯৫১ খ্রি. ভারতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে অতি দ্রুত ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৬ খ্রি.)

১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

লক্ষ্য : [i] যুদ্ধ ও দেশবিভাগের ফলে সৃষ্ট ভারতের অর্থনৈতিক সংকট দূর করা। [ii] উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা এবং ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো।

পদক্ষেপ : এই পরিকল্পনায় কৃষি, সেচ, শক্তি উৎপাদন, গোষ্ঠী উন্নয়ন, পরিবহণ, পুনর্বাসন প্রভৃতি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

অগ্রগতি : প্রথম পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলি মোটামুটিভাবে সফল হয়েছিল। এই পরিকল্পনার ফলে ভারতের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

মূল্যায়ন : কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। [i] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলা স্থিতাবস্থার অবসান ঘটে। [ii] প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতে পরিকল্পিত অর্থনীতির পথ-চলা শুরু হয়।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫৬-৬১ খ্রি.)

নেহেরু-মহলানবিশ মডেল : নেহরুর আদর্শকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি রূপরেখা বা মডেল তৈরি করেন। এই মডেল ‘নেহরু-মহলানবিশ মডেল’ নামে পরিচিত।

লক্ষ্য : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল – [i] জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা, [ii] ভারী শিল্প ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। [iii] কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, [iv] কুটির-শিল্পের বিকাশ ঘটানো।

অগ্রগতি : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য আশানুরূপ হয়নি। তবে এর দ্বারা জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন যথেষ্ট বাড়ে, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয় ইত্যাদি।

মূল্যায়ন : বিভিন্ন ব্যর্থতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কয়েকটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলি হল – [i] এই পরিকল্পনায় শক্তি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। [ii] ভারী শিল্প ও শিল্পপ্রযুক্তির অগ্রগতিও যথেষ্ট হয়েছিল। [iii] অন্তত ৯০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল।

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১১৬১-৬৬ খ্রি.)

সরকার ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

লক্ষ্য : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল-[i] প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে জাতীয় আয় বাড়ানো, [ii] খাদ্যোৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া, [iii] ইস্পাত, রাসায়নিক দ্রব্য, শিল্প-যন্ত্রপাতি, শক্তি প্রভৃতির উৎপাদন বৃদ্ধি করা, [iv] কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা।

অগ্রগতি : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বহু ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। চিনের ভারত আক্রমণ, ভারত-পাক যুদ্ধ, ব্যাপক খরা প্রভৃতি ঘটনা এই ব্যর্থতার জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল।

স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়। [ii] (a dismal failure)। [iii] ইস্পাত, কয়লা, সিমেন্ট, বিদ্যুৎ প্রভৃতি উৎপাদনও আশানুরূপ হয়নি। [iv] পরিকল্পনার শেষে বেকারসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ⑤ 

মূল্যায়ন : কৃষিক্ষেত্রে শোচনীয় ব্যর্থতা দেখা দেয়। অমলেশ ত্রিপাঠী একে ‘একটি হতাশাজনক ব্যর্থতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সমকালীন কয়েকটি ঘটনা তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত