অব-উপনিবেশীকরণ বলতে কী বোঝায়? এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

(উত্তর) অব-উপনিবেশীকরণ কী?

অর্থ : ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে জার্মান পণ্ডিত জুলিয়াস বন সর্বপ্রথম ‘Decolonisation শব্দটি ব্যবহার করেন। এই শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল “অব-নিবেশীকরণ”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯৪৫ খ্রি.) এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশগুলি পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে তীব্র সংগ্রাম শুরু করে এবং অধিকাংশ উপনিবেশই স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনতা থেকে উপনিবেশগুলির মুক্তির ঘটনাকেই ‘অব-উপনিবেশীকরণ’ বা ‘Decolonisation’ বলা হয়ে থাকে। বিংশ শতকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ থেকে ঔপনিবেশিক শাসন লুপ্ত হয় অর্থাৎ পৃথিবীতে অব-উপনিবেশীকরণ ঘটে।

বিতর্ক : অব-উপনিবেশবাদ বলতে অনেকে বুঝিয়েছেন, ভূতপূর্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক উপনিবেশিগুলির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সমর্পণ অথবা সার্বভৌম ক্ষমতা সাম্রাজ্যের হাত থেকে জাতি রাষ্ট্রগুলির হাতে সমর্পণ করা। তবে অব-উপনিবেশীকরণ নাকি স্বাধীনতা সংগ্রাম কোন্‌টি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ? মুক্তিসংগ্রাম ও গণ-আন্দোলনের চাপে ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়া – এই অর্থটিই সমধিক প্রযোজ্য।

অব-উপনিবেশীকরণের  তাৎপর্যসমূহ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান অর্থাৎ উপনিবেশগুলির পতন ঘটতে থাকে। এই ঘটনার বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য লক্ষ করা যায়। এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

সামাজিক তাৎপর্য

বর্ণ-বৈষম্যবাদের গতিরোধ : ঔপনিবেশিক শাসনকালে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশে যে বর্ণ-বৈষম্যবাদের সূচনা হয়েছিল, অব-উপনিবেশীকরণের ফলে সেই বর্ণ-বৈষম্যবাদের গতি রুদ্ধ হয়।

অস্থির পরিস্থিতির উদ্ভব : আফ্রিকার বেশ কিছু উপনিবেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এতটাই দুর্বল ছিল যে, তারা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশে সঠিক সুস্থ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় এবং দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নেয়।

এলিট গোষ্ঠীর শক্তিবৃদ্ধি : সদ্য-স্বাধীন বহু রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা সে দেশের শিক্ষিত ও ধনী এলিট গোষ্ঠীর করায়ত্ত হয়। দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এই সমস্ত গোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচারে বিস্তর পার্থক্য ছিল।

রাজনৈতিক তাৎপর্য

তৃতীয় বিশ্বের উত্থান : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অব-উপনিবেশীকরণ ঘটে। এর ফলে এইসব মহাদেশের অন্তর্গত বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। সদ্য-স্বাধীন এইসব দেশ তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত। 

নতুন বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অব-উপনিবেশীকরণের ফলে পুরোনো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির অধীনতা ছিন্ন করে জাতিভিত্তিক ক্ষুদ্র-বৃহৎ অসংখ্য রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফলে নতুন রাজনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। 

সাম্রাজ্যবাদের গতিরোধ : অব-উপনিবেশীকরণের ফলে সাম্রাজ্যবাদী অধীনতা ছিন্ন করে অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। সদ্য-স্বাধীনপ্রাপ্ত এই সব রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী হয়ে ওঠে।

রাজনীতির প্রসার : এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বহু নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটলে পূর্বেকার ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রক্ষা করতে বাধ্য হয়। এভাবেই অব-উপনিবেশীকরণের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির দিগন্ত বহুদূর প্রসারিত হয়।

ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রসার : সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচার-প্রসারে এবং আমেরিকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন পুঁজিবাদের প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়। রাশিয়া ও আমেরিকা উভয়েই নিজেদের স্বার্থে এইসব দেশে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দানের জন্য এগিয়ে এলে দেশগুলি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব : সদ্য-স্বাধীন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘর্ষ শুরু হয়

অর্থনৈতিক তাৎপর্য

অর্থনৈতিক দুর্বলতা : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দীর্ঘদিন ধরে তাদের অধীনস্থ উপনিবেশগুলিকে শোষণ করার ফলে উপনিবেশগুলি অর্থনৈতিকভাবে একসময় নিঃস্ব হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির ওপরই এই উপনিবেশগুলি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে দেশের কৃষি উৎপাদন, শিল্পায়ন প্রভৃতি ব্যাহত হয় এবং সামগ্রিক উন্নয়ন থমকে যায়।

নয়া উপনিবেশবাদ : বৃহৎ শক্তিগুলি সদ্য-স্বাধীন দেশগুলিতে অর্থনৈতিক সহায়তা দান করে সেখানে নিজেদের প্রভাব- প্রতিপত্তি ও পরোক্ষভাবে শোষণ বৃদ্ধি করে। ফলে এসব রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের শিকার হয়। এবং ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অর্থনৈতিক সহায়তাদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করার ঘটনাই হল নয়া-উপনিবেশবাদ।

আঞ্চলিক সহযোগিতা : অব-উপনিবেশীকরণের একটি সদর্থক দিক ছিল আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি নিজেদের সমস্যার সমাধান ও সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে সহযোগিতামূলক বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তোলে। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক সংগঠন হল – ASEAN, SAARC, আরব লিগ প্রভৃতি।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত