১৯৫০-এর দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কমিউনিস্ট চিনের প্রভাব নিরূপণ করো।

(উত্তর) গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান : চিনের কমিউনিস্ট নেতা মাও-সে-তু-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বা People’s Republic of China-র প্রতিষ্ঠা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠা শুধু চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। 

ঐক্যবদ্ধ গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপর থেকে চিন বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কমিউনিস্ট চিনের প্রভাব

(১) সমৃদ্ধশালী চিন : চিনের ওপর বিদেশি শক্তিগুলির শোষণ ও অত্যাচার বন্ধ করে মাও-সে-তুঙ্‌ চিনা জাতির জীবনে আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে আনেন। এর ফলে চিনাদের জাতীয় জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী চিন জগৎ সভায় মাথা তুলে দাঁড়ায়।

(২) সামরিক অগ্রগতি : চিন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ১৭টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ২০০-৩০০টি পরমাণু বোমা তৈরি করে। ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ব্যবস্থায়ও চিন দক্ষতা অর্জন করে। চিন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

(৩) বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি : চিনে শিল্প প্রযুক্তি, পরিবহণ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রভূত বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটেছে। তাছাড়া চিন বহু আগেই কম্পিউটারের মতো অতি সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে।

(৪) কমিউনিস্ট শিবিরে চিনের উত্থান : ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট চিনের উত্থানের ফলে কমিউনিস্ট শিবিরের প্রবল শক্তিবৃদ্ধি হয়। সোভিয়েত রাশিয়া, চিন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির গড়ে ওঠে। 

(৫) এশিয়ায় চিনের প্রাধান্য : কমিউনিস্ট চিনের উত্থানে এশিয়ায় কমিউনিস্টরা প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কোরিয়া সংকট, ভিয়েতনাম সংকটের মতো আন্তর্জাতিক সংকটের ক্ষেত্রে চিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।

(৬) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের প্রাধান্য : চিনের উত্থানের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশই উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, চিনকে এড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিসাম্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

(৭) তৃতীয় বিশ্বের নেতা : চিন হল এশিয়া মহাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। গুরুত্বের জন্য চিন এশিয়া মহাদেশ ও উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

(৮) জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভূমিকা : ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চিন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছে। ‘পঞ্চশীল’ ও ‘দশশীল’ নীতি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।

(৯) আন্তর্জাতিক সংকটে অবদান : চিন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনায় যথেষ্ট সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরের ওপর ইজরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যৌথ আক্রমণ শুরু হলে চিন মিশরের প্রতি সমর্থন জানায়। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত রাজনীতিতে চিন আরব জাতীয়তাবাদকে সমর্থন জানায়।

(১০) রাশিয়ার সঙ্গে সু-সম্পর্ক : কমিউনিস্ট চিনের উত্থানে রাশিয়া খুশি হয় এবং উভয় দেশের মধ্যে রেলপথ নির্মাণ, আর্থিক ঋণদান, পারস্পরিক মৈত্রী প্রভৃতি বিষয়ে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এভাবে বৃহৎ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র দুটির মধ্যে মৈত্রী সুদৃঢ় হয়। 

(১১) নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট চিনের ভূমিকা এতটাই মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের পঞ্চম স্থায়ী সদস্য হিসেবে চিনের উত্থান ঘটে।

প্রকৃতপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে চিন প্রজাতন্ত্রের উত্থান আরো দ্রুত গতিতে ঘটে। বর্তমানে চিন এশিয়ার সর্বোচ্চ অর্থনীতির একটি দেশে পরিণত হয়েছে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত