জোটনিরপেক্ষ নীতি কী ছিল? জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য আলোচনা করো।

(উত্তর) ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিমেরু-রাজনীতির উদ্ভব ঘটে। একদিকে আমেরিকা-কেন্দ্রিক এবং অপরদিকে রাশিয়া-কেন্দ্রিক। তবে এই দুটি জোটের বাইরে যেসব রাষ্ট্র স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল, সেই দেশগুলি “জোটনিরপেক্ষ দেশ” নামে পরিচিতি পায়। এইসব দেশের মূল লক্ষ্যই ছিল জোটনিরপেক্ষতা।

জোটনিরপেক্ষ নীতি কী : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের কিছু রাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক কোনো জোটেই যোগ না দিয়ে উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সমদূরত্ব বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে নিজেদের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করত। প্রথম দুটি জোটের বাইরে অবস্থানকারী দেশগুলির এই নীতি ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ নামে পরিচিত।

জওহরলাল নেহরু বলেছেন যে, জোটনিরপেক্ষতা নীতি নেতিবাচক নয়, এটি হল ইতিবাচক নীতি। জোটনিরপেক্ষতা বলতে গতিশীল নিরপেক্ষতা বোঝায়। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি আন্তর্জাতিক বিরোধে না জড়িয়েও বিশ্বরাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ভারত-সহ বিভিন্ন জোটনিরপেক্ষ দেশ ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে আপস বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিভিন্ন বিরোধের মীমাংসায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে জোটনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রসার ঘটাতে থাকে। ক্রমে এই আদর্শের বিস্তারলাভ লক্ষ করা যায়। এই ঘটনা “জোটনিপরপেক্ষ আন্দোলন” নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য লিপিবদ্ধ হল : 

  1. দ্বিমেরুকরণ থেকে দূরত্ব : জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির মার্কিন নেতৃত্বাধীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন—উভয় সামরিক জোট থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকা। 
  2. বিশ্বে শান্তি স্থাপন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উদ্ভূত ঠান্ডা লড়াইয়ের বিরোধিতা করে বিশ্বে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখায় গুরুত্ব দেওয়া। 
  3. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা : প্রতিটি দেশের অখণ্ডতা রক্ষা ও সার্বভৌমিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থান গ্রহণ করা।
  4. আগ্রাসনের বিরোধিতা : বিশ্ব রাজনীতিতে যে-কোনো রকম আক্রমণ বা আগ্রাসনের বিরোধিতা করা। 
  5. বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন : আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মিশ্র ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
  6. রাষ্ট্র সংঘের নীতি-আদর্শ : রাষ্ট্রসংঘের নীতি ও আদর্শ মেনে এই সংগঠনের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

মূল্যায়ন : জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব জনমত গঠন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে অনেকটা পথ অগ্রসর হয়েছে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের সদ্যস্বাধীন, দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ ও জাতিগুলিকে নিজেদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। 

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত