--------------------------------------------------
--------------------------------------------------


--------------------------------------------------
--------------------------------------------------

কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

(উত্তর) ভূমিকা : কিউবা হল ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপ। কিউবা ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের অধীনতা ছিন্ন করলেও ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত প্লাট চুক্তি-র দ্বারা কিউবার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করার অধিকার পায়। আর আর্থিক বিচারে কিউবা ছিল একটি মার্কিন উপনিবেশ। কিউবার যাবতীয় উৎপাদনের ওপর মার্কিন পুঁজিপতিদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং আমেরিকার শোষণে কিউবার সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দারিদ্র্য ও দুর্দশা নেমে এসেছিল।

কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের নানাদিক

ফিদেল কাস্ত্রো ও কিউবার পরিস্থিতি : 

  1. (১) ফিদেল কাস্ত্রোর ক্ষমতা দখল : মার্কিন পোষকতায় ফ্যালজেনিকো বাতিস্তা ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কিউবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কিউবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু বাতিস্তা সরকারের অপদার্থতার সুযোগে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার শাসনক্ষমতা দখল করেন।
  2. আমেরিকার ক্ষোভ : কাস্ত্রো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি রাশিয়াসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করেন। তাছাড়া লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের মার্কিন-বিরোধী আন্দোলনকে উৎসাহিত করেন। ফলত আমেরিকা কাস্ত্রোর প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়।
  3. কাস্ত্রো বিরোধী বিদ্রোহ : ক্ষুদ্ধ আমেরিকা কিউবাকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে কিউবার কমিউনিস্ট-বিরোধী দেশত্যাগী শরণার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমেরিকা কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মদত দিতে থাকে। ১৪০০ কাস্ত্রো-বিরোধী কিউবার পিগ উপসাগরে অবতরণ করায়। যদিও মাত্র ২ দিনের মধ্যে কাস্ত্রো-বিরোধী বিদ্রোহ দমিত হয়।

আমেরিকা-রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ : 

  1. আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি : ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে আমেরিকা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল। যেগুলি শত্রু রাষ্ট্রগুলিকে, বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়াকে নিশানা করেছিল। বিদেশের মাটিতে তখনও পর্যন্ত রাশিয়ার এধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ছিল না।
  2. রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি : ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা জানতে পারে যে, কিউবায় সোভিয়েত রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। এখান থেকে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র সমগ্র আমেরিকা তথা সমগ্র পশ্চিম গোলার্ধের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। এতে আমেরিকা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়।

মার্কিন ও রুশ প্রতিক্রিয়া : কিউবায় রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির নির্মাণ প্রসঙ্গে আমেরিকা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। অন্যদিকে রাশিয়াও পালটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ক্রমশ যুদ্ধ-পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

  1. আমেরিকার প্রতিক্রিয়া : কিউবায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির অবস্থানের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি কিউবার চতুর্দিকে নৌ-অবরোধ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেন। এবং ঘোষণা করেন যে, কিউবাগামী সব দেশের জাহাজ সম্পূর্ণ অনুসন্ধানের পর কিউবায় যেতে দেওয়া হবে। কিউবা থেকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হলে আমেরিকা এর জন্য সোভিয়েত রাশিয়াকে দায়ী করবে এবং সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর পালটা আক্রমণ চালানোর বিষয়ে আমেরিকা কোনো দ্বিধা করবে না।
  2. পাল্টা রুশ প্রতিক্রিয়া : মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডির ঘোষণার বিরুদ্ধে রাশিয়াও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। রুশ সরকার তাঁর সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেয়। সেনাবিভাগের কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং বিদায়ী কর্মচারীদের সাময়িকভাবে অবসর গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়। সোভিয়েত সরকার জানিয়ে দেয় যে, কিউবাগামী কোনো জাহাজ বাধাপ্রাপ্ত হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালানো হয়।

এভাবে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব এক ভয়াবহ আণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি উপস্থিত হয়।

পরবর্তী পরিস্থিতি : 

  1. জাতিপুঞ্জ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি কিউবা, আমেরিকা এবং রাশিয়া তিন পক্ষকেই শান্তিরক্ষার অনুরোধ জানান।
  2. রুশ প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডিকে জানান যে, আমেরিকা যদি কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিউবা থেকে নৌ-অবরোধ প্রত্যাহার করে, তবে সোভিয়েত রাশিয়াও কিউবা থেকে ঘাঁটি সরিয়ে নেবে।
  3. শেষ-পর্যন্ত ১৯৬২ খ্রি. সোভিয়েত রাশিয়া কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি সরিয়ে নেয় এবং আমেরিকাও কিউবার নৌ-অবরোধ তুলে নেয়। এইভাবে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির সমস্যার সমাধান হয়।

মূল্যায়ন : কিউবা সংকটের স্থায়িত্বকাল সামান্য হলেও বিশ্ব রাজনীতিতে এই ঘটনার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  1. কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত যুদ্ধের হাত থেকে সমগ্র বিশ্ব রক্ষা পায়।
  2. সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি ক্রুশ্চেভের দূরদৃষ্টি ও বিশ্বশান্তির প্রতি আগ্রহ কিউবার সংকট সমাধানে বিশেষ সহায়তা করেছিল।
  3. কিউবা সংকট সমস্যার সমাধান ছিল এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, যেখানে আলোচনার মাধ্যমে বৃহৎ সমস্যার মীমাংসা হয়। 
  4. কিউবা সংকট সমাধানের পর আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ আণবিক বোমা পরীক্ষার ওপর আংশিক বাধানিষেধ আরোপ করে।
error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত