(উত্তর) ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চল জার্মানির হাত থেকে মুক্ত করে সেখানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এসব অঞ্চলে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসার ও অনুগত কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পূর্ব ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, পোল্যান্ড ও পূর্ব জার্মানি-এই আটটি দেশে রুশ-অনুগত কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতীকরণের উদ্দেশ্য
পূর্ব ইউরোপে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পিছনে রাশিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্যগুলি হল :
সাম্যবাদী আদর্শের প্রসার : স্ট্যালিন মনে করতেন যে, সকল বিজেতাই বিজিত অঞ্চলের ওপর নিজেদের মতাদর্শ ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই পূর্ব ইউরোপের রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং সাম্যবাদী ভাবধারার ধারাবাহিক প্রসারের উদ্যোগ যুক্তিসংগত।
সুযোগ গ্রহণ : যুদ্ধ-পরবর্তী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের আর্থিক ও সামরিক শক্তি নিঃশেষিত হওয়ার ফলে রাশিয়া সুযোগ বুঝে পূর্ব ইউরোপে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
নিরাপত্তা-বলয় : রাশিয়া আক্রমণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রুখতে রাশিয়া পূর্ব ইউরোপে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে একটি নিরাপত্তা-বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল।
অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন : যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য পূর্ব ইউরোপের সম্পদের ব্যবহার এবং এখানকার বাজার দখল রাশিয়ার কাছে খুবই প্রয়োজন ছিল।
কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান : পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাশিয়া নিজস্ব প্রভাব-বলয় তৈরি করে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
বিভিন্ন দেশে সোডিয়েতিকরণের প্রভাব
পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, পূর্ব জার্মানি প্রভৃতি দেশে রাশিয়ার উদ্যোগে সোভিয়েতিকরণ ঘটে। সংক্ষেপে এর আলোচনা করা হল।
(ক) পোল্যান্ড :
- রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট নেতা বলেস্লাভ বেরাট-এর নেতৃত্বে পূর্ব পোল্যান্ডে সোভিয়েতপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
- সোভিয়েতপন্থী সরকার এরপর পোল্যান্ডের একটি বিরাট অংশ রাশিয়াকে প্রদান করে।
- এই সরকারে কয়েকজন অকমিউনিস্ট মন্ত্রী গ্রহণ করা হলেও তাদের কোনো ক্ষমতা ছিল না।
- বিভিন্ন অকমিউনিস্ট দলগুলিকে মুছে দেওয়া হয় এবং অকমিউনিস্টদের কঠোরভাবে দমন করা হয়। এভাবে পোল্যান্ড সবদিক থেকে রাশিয়ার তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
(খ) রুমানিয়া :
- রুমানিয়া জার্মানির আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে রাজতন্ত্র-শাসিত রাষ্ট্রের তকমা পেলেও খুব শীঘ্রই স্ট্যালিন রাজা মাইকেলকে কমিউনিস্টদের নিয়ে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের নির্দেশ দেন।
- রুমানিয়ার সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতা লাভ করে নতুন সরকার কমিউনিস্ট-বিরোধীদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার শুরু করে।
- এরপর রাজা মাইকেল পদত্যাগ করলে বিরোধী-বর্জিত অনুগতদের নিয়ে ‘রুমানিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি’ গঠিত হয়।
(গ) বুলগেরিয়া :
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বুলগেরিয়ায় কমিউনিস্ট, অকমিউনিস্টদের নিয়ে সোভিয়েত-অনুগত ‘Fatherland Front’ গঠন করা হয়। এবং এরপর ক্রমে অকমিউনিস্টদের নিধন শুরু হয়।
- জাতীয়তাবাদী নেতা নিকোলা পেটকড কমিউনিস্টদের প্রবল বিরোধিতা শুরু করলে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
- অবশেষে জর্জ ডিমিট্রভ-এর নেতৃত্বে রুশ সেনাবাহিনী রাজা দ্বিতীয় সাইমনকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং বুলগেরিয়ায় একটি রুশ তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
(ঘ) হাঙ্গেরি :
- বুলগেরিয়ার মত হাঙ্গেরিতেও রাশিয়ার উদ্যোগে কমিউনিস্ট এবং অকমিউনিস্টদের নিয়ে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
- জাতীয় সভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির তুলনায় ক্ষুদ্র ভূস্বামীদের দল বেশি আসনে জয়লাভ করে। ফলে হাঙ্গেরিতে একটি উদারনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
- কিন্তু অচিরেই ক্ষুদ্র ভূস্বামীদের দলের নেতাদের দমন করতে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তাদের দলের অনেক নেতার বিচার শুরু হয়।
- পরে রাশিয়ার সহায়তায় উদারনৈতিক সরকারের পতন ঘটে এবং অকমিউনিস্টদের ওপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। হাঙ্গেরিতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ঙ) চেকোশ্লোভাকিয়া :
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর অকমিউনিস্ট এডওয়ার্ড বেনেস চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন।
- তবে বেনেসের সরকার ‘মার্শাল পরিকল্পনা’ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে রাশিয়া শঙ্কিত হয় যে, চেকোশ্লোভাকিয়ায় রুশ আধিপত্য বিনষ্ট হবে। ফলে স্ট্যালিনের নির্দেশে চেকোশ্লোভাকিয়ায় অকমিউনিস্ট নিধন শুরু হয়।
- দেশে কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্টদের মধ্যে প্রবল বিরোধ শুরু হয়। এবং শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বেনেস পদত্যাগ করেন। কমিউনিস্টপন্থী প্রধানমন্ত্রী গোটাওয়াল্ড প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। এভাবে চেকোশ্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট প্রভাব প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়।
(চ) যুগোশ্লাভিয়া :
- কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে যুগোশ্লভিয়ার মানুষ সংগ্রাম করে জার্মান বাহিনীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। মার্শাল টিটো হন প্রধানমন্ত্রী।
- টিটোর নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুগোশ্লাভিয়ার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
- কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে টিটোর সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। টিটো রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায়নি।
- টিটো নিজের দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে কমিউনিস্ট দেশগুলির সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং যুগোশ্লাভিয়াকে ‘কমিনফর্ম’ থেকে বিতারিত করা হয়।
আলোচিত দেশগুলি ছাড়াও আলবেনিয়া, পূর্ব জার্মানিতে রাশিয়ার আধিপত্য লক্ষ করা গিয়েছিল। এককথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার মতাদর্শ বিস্তারলাভ করেছিল।