ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

(উত্তর) ১৯৪৫ খ্রি. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকা ও রুশজোট কেন্দ্রিক যে যুদ্ধের আবহের জন্ম হয়, তা ঠান্ডা লড়াই নামে অভিহিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন কয়েকটি সিদ্ধান্ত এই ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহে ইন্ধন জুগিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ট্রুম্যান নীতি এবং মার্শাল পরিকল্পনা ঘোষণা।

ট্রুম্যান নীতি

ট্রুম্যান নীতি কী : মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় ঘোষিত নীতিসমূহ ‘ট্রুম্যান নীতি’ নামে পরিচিত। এই বক্তৃতায় তিনি বলেন যে,

(ক) বিশ্ব এখন দুটি পরস্পরবিরোধী আদর্শ ও জীবনচর্যায় বিভক্ত – একটি হল মুক্ত গণতান্ত্রিক দুনিয়া, অন্যটি হল সাম্যবাদী দুনিয়া।

(খ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব হল মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করা।

(গ) বিশ্বের যে-কোনো মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কমিউনিস্ট গোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হলে, আক্রান্ত রাষ্ট্রকে আমেরিকা সব ধরনের সহায়তা দান করবে।

ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার কারণ : যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি, পূর্ব ইউরোপে রুশ অগ্রগতি প্রভৃতি ঘটনা আমেরিকা-সহ পশ্চিমি শক্তিগুলিকে চিন্তিত করে তোলে। এছাড়াই ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার কারণগুলি হল : 

প্রথমত, ইংল্যান্ড আমেরিকাকে জানায়, গ্রিসে কমিউনিস্ট প্রাধান্য স্থাপিত হলে সমগ্র ভূমধ্যসাগর ও বলকান অঞ্চল মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন বাণিজ্যে যাতে মন্দা না দেখা দেয় বা অস্ত্র কারখানাগুলিতে যাতে উৎপাদন হ্রাস এবং কর্মী ছাঁটাই না হয় সে উদ্দেশ্যে মার্কিন বণিক ও শিল্পপতিদের চাপ ছিল।

তৃতীয়ত, সাহায্য ও ঋণদানের নামে আমেরিকার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বিদেশের বাজার দখল। আমেরিকা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিনা শুল্কে ঋণদান, উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী ও অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিল।

মূল্যায়ন : ট্রুম্যান নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে একদিকে যেমন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য লাভে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অন্যদিকে তেমনি আন্তর্জাতিক সংকট বৃদ্ধি করেছিল।

মার্শাল পরিকল্পনা

মার্শাল পরিকল্পনা : ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার কয়েক মাস পর মার্কিন পররাষ্ট্র-সচিব জর্জ মার্শাল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আর্থিক পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন এবং ‘ইউরোপীয় পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা’ নামে এক কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন। মার্শালের নামানুসারে এই কর্মসূচি সাধারণভাবে ‘মার্শাল পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত হয়।

মার্শাল পরিকল্পনার নীতিসমূহ : (১) মার্কিন নীতি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে। (২) পশ্চিম ইউরোপের দারিদ্র্য, ক্ষুধা, হতাশা, বেকারত্ব ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে আমেরিকা অর্থসাহায্য করবে। (৩) সাহায্য গ্রহণকারী দেশকে মূল মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী সাহায্যপ্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। ইত্যাদি।

মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণের কারণ : যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও আরও কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকা মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।

প্রথমত, যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল পরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকটের ফলে ইউরোপে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের দ্রুত প্রসার ঘটে। তাই কমিউনিস্টদের অগ্রগতি রুখতে চেয়েছিল আমেরিকা।

তৃতীয়ত, সাম্যবাদী ভাবাদর্শ ও রুশ আধিপত্যের ক্রমাগত প্রসারের ফলে আমেরিকা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা চিন্তিত হয় এই ভেবে যে, সাম্যবাদের অগ্রগতি রোধ করতে না পারলে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে শীঘ্রই রুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মার্কিন নিরাপত্তা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।

চতুর্থত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকায় মুক্ত অর্থব্যবস্থার প্রসার ঘটে। বিপুল পরিমাণ ঋণদানের মাধ্যমে ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ওই অঞ্চলে মার্কিন ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটানোও মার্শাল পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

পঞ্চমত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে অর্থসাহায্যের মাধ্যমে একটি অনুগত রাষ্ট্রজোট গঠন করাও ছিল মার্শাল পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য।

মার্শাল পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও বয়কট : মার্শাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মার্কিন কংগ্রেস বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুমোদন করে। তবে অর্থসাহায্য গ্রহণ করার বিষয়ে বিভিন্ন দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, তুরস্ক, পশ্চিম জার্মানি-সহ পশ্চিম ইউরোপের ১৬টি দেশ মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও রুশ প্রভাবিত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি মার্শাল পরিকল্পনা বয়কট করে। তারা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘কমিউনিস্ট ইকনমিক ইউনিয়ন’ বা ‘কমিকন’ (COMECON) নামে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

মার্শাল পরিকল্পনার ফলাফল ও গুরুত্ব : মার্শাল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া ও তার নেতৃত্বাধীন পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেও এই পরিকল্পনা যে উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল তা অনেকাংশে সফল হয়। এই পরিকল্পনার গুরুত্ব সূত্রাকারে বিবৃত হল। 

  1. ইউরোপের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্পন্ন হয়।
  2. মার্কিন বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার ঘটে।
  3. মার্কিনি অর্থ-সাহায্যে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
  4. চেকোশ্লোভাকিয়ায় রুশ আগ্রাসনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  5. মার্শাল পরিকল্পনার ফলে ইউরোপীয় রাজনীতি ও অর্থনীতি পরস্পরবিরোধী সুস্পষ্ট দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায় এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত