সুয়েজ সংকট কেন দেখা দিয়েছিল?

(উত্তর) সুয়েজ সংকট কী : লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর সংযোগকারী যে খালটি বিশ্ববাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সেটি সুয়েজ খাল। মিশর ও আরব-উপদ্বীপের মধ্যে এই খালের অবস্থান। প্রথমে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে সুয়েজ খাল খনন বা সংস্কার করা হয় ১৮৫৯ সালে । পরে ১৮৬৯ সালে এই খাল দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলতে শুরু করে । “ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি” নামে একটি সংস্থা ৯৯ বছরের দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়ে সুয়েজ খালের দেখভালের দায়িত্ব নেয়। যদিও মেয়াদ শেষের আগেই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খাল এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির জাতীয়করণ করেন । ফলত সুয়েজ খালকে ঘিরে তৈরি হয় আন্তর্জাতিক সমস্যা। এটাই ‘সুয়েজ সংকট’ নামে পরিচিত।

সুয়েজ সংকটের প্রেক্ষাপট

বিংশ শতকের মধ্যভাবে উদ্ভূত সুয়েজ সংকটের প্রেক্ষাপট বিচার-বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি কারণ উঠে আসে। সেগুলি নিম্নে সংক্ষেপে উদ্ধৃত হল : 

পশ্চিমি শক্তিবর্গের সঙ্গে নাসেরের বিরোধের সূচনা : গামাল আবদেল নাসের মিশরের ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিভিন্ন কারণে পশ্চিমি শক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইজরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে নাসেরের সংঘাত বাঁধে এবং রাশিয়ার সঙ্গে মিশরের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। এই বিষয়টি পশ্চিমি শক্তি ভালো চোখে দেখেনি।

সুয়েজ খাল জাতীয়করণ-পূর্ববর্তী মিশরের পরিস্থিতি : 

  1. আর্থিক সমস্যা : কোম্পানি দ্বারা চুক্তির ভিত্তিতে সুয়েজ খাল পরিচালিত হত বলে খাল থেকে আদায় হওয়া অর্থের খুব সামান্য অংশ মিশর পেত। মিশরের মধ্যে দিয়ে এই খাল প্রবাহিত হলেও লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হত মিশর।
  2. ব্রিটেনের সামরিক কর্তৃত্ব : খালের নিরাপত্তার জন্য এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন থাকায় সুয়েজ খাল ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে মিশরের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই মিশরের সার্বভৌমত্বের জন্য এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।
  3. বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প : গামাল আবদেল নসের মিশরের নীলনদের ওপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। এই বাঁধ নির্মিত হলে মিশরের ৮,৬০,০০০ হেক্টর জমি আবাদযোগ্য হত এবং বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হত। তাই নাসের চেয়েছিলেন এই বাঁধ যেভাবেই হোক নির্মাণ সম্পন্ন করতে।
  4. ঋণ সংক্রান্ত ঝামেলা : আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ১৪০০ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পের জন্য ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে ৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পরামর্শে বিশ্বব্যাংক ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঋণ-প্রস্তাব বাতিল করে দেয়।

সুয়েজ খালের জাতীয়করণ : বাঁধ নিমার্ণের জন্য ঋণ-প্রস্তাব বাতিল হলে মিশরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও গণরোষ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে নাসের ঐ বছরেই সুয়েজ খাল ও ‘সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি’ জাতীয়করণ করার কথা ঘোষণা করেন।

পশ্চিমি জোটের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপন্নতা : মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের কথা ঘোষণা করলে পশ্চিমি জোটের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই জাতীয়করণের ঘোষণার ফলে পাশ্চাত্য দেশগুলির মধ্যে ভীতি, বিরোধিতা ও কর্মতৎপরতা শুরু হয়ে যায়।

  1. ব্রিটেনের ক্ষোভ : ব্রিটেন সুয়েজ খালের পথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কাঁচা তেল আমদানি করত। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানির ৪৪ শতাংশ শেয়ারও ছিল ব্রিটেনের। এজন্য খাল জাতীয়করণের ফলে ব্রিটেন ক্ষুব্ধ হয়।
  2. ফ্রান্সের ক্ষোভ : ফ্রান্সের উপনিবেশ আলজিরিয়ার বিদ্রোহীদের সহায়তা করায় ফ্রান্স আগেই নাসেরের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিল।
  3. ইজরায়েলের ক্ষোভ : ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে নাসেরের ক্ষমতা ধ্বংস করে সুয়েজ খাল দিয়ে তাদের জাহাজ চলাচল সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিল। এককথায় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েল একজোট হয়ে মিশর আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেছিল। 
  4. আমেরিকার ভূমিকা : আমেরিকা মিশরের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের বিরোধী ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল সুয়েজ খালকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনা। ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের মতো আমেরিকা সুয়েজ খালের ওপর ততটা নির্ভরশীল ছিল না বলে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পৃথক ছিল।

লন্ডন সম্মেলন :  সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্তে যে সমস্যা দেখা দেয় তার সমাধানের উদ্দেশ্যে আমেরিকার উদ্যোগে লন্ডনে সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলির এক সম্মেলন ডাকা হয় ১৯৫৬ খ্রি.। লন্ডন সম্মেলনে মিশর যোগদানে অসম্মতি জানায়। এখানেও বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়।

জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ : আবদেল নাসের সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কাছে সুয়েজ সমস্যা পেশ করলে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুয়েজ খালের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। যদিও নাসেরের আপত্তি ও সোভিয়েত রাশিয়ার ‘ভেটো’ প্রয়োগের ফলে এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

যুদ্ধ পরিস্থিতি ও যুদ্ধের অবসান : গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী ইজরায়েল ২৯ অক্টোবর, ১৯৫৬ খ্রি. মিশর আক্রমণ করে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই সিনাই উপত্যকা দখল করে নেয়। জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাতে ‘ভেটো’ দেয়। শুধু তাই নয়, মিশরের রাজধানী কায়রোর ওপর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে। ফলে মিশরে যুদ্ধ পরিস্থিতির সূচনা ঘটে।

এদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আমেরিকার কাছে মিশর আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপন করায় আমেরিকা প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়। তাছাড়া আমেরিকা যুদ্ধের বিরোধী ছিল, কারণ আমেরিকা আরব জাতীয়তাবাদকে খুশি করতে চেয়েছিল। এদিকে সোভিয়েত রাশিয়া ঘোষণা করে যে, মিশরের ওপর ব্রিটেন ও ফ্রান্স বিমানহানা বন্ধ না করলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ওপর রকেট হামলা করা হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মিশর আক্রমণের নিন্দা করে। বিশ্বজনমতের চাপ, মার্কিন বিরোধিতা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার রকেট হানার হুমকিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স পিছু হঠে। জাতিপুঞ্জের নির্দেশে মিশর থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েল তাদের সৈন্য অপসারণে বাধ্য হয়।

মূল্যায়ন : প্রকৃতপক্ষে সুয়েজ সংকটকে কেন্দ্র করে বিংশ শতকের মধ্যভাগে উদ্ভূত “ঠান্ডা লড়াই” আরব জগতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ আরবজগতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আধিপত্য খর্ব হয়। পরিবর্তে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাসেরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এককথায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সুয়েজ সংকটের প্রভাব ছিল সুগভীর।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত