এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়ানীতি বলতে কী বোঝ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কেন এই নীতি গ্রহণ করেছিল?

[উ]  

এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া নীতি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) শুরু হলে জাপান চিনদেশে সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হয়। জাপান ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে চিনের কাছে ‘একুশ দফা দাবি’ পেশ করে এবং এই দাবিপত্রে চিনে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্থলে কেবল জাপানের অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার ভোগ করার দাবি করা হয়। এই একুশ দফা দাবিগুলি চিনের সার্বভৌমত্বের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল এবং চিনে জাপানের একপ্রকার অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই  ‘একুশ দফা দাবি’-কে ‘এশিয়ার মনরো নীতি’ অর্থাৎ ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়।

একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এশিয়ার উপনিবেশগুলি থেকে পশ্চিমি শক্তিগুলিকে (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ডাচ প্রভৃতি) বিতাড়িত করে নিজের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটানোয় সক্রিয় উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের স্লোগান ছিল ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ (‘Asia for Asians’)। অর্থাৎ এশিয়ার ভূখণ্ডে পশ্চিমি দেশগুলির আধিপত্য জাপান স্বীকার করবে না। এই স্লোগানের আড়ালে জাপানের প্রকৃত বক্তব্য ছিল ‘পশ্চিমি শক্তিগুলি নয়, এশিয়ায় কর্তৃত্ব করবে জাপান।

‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ স্লোগানের উদ্দেশ্য

জাপান কেন এই নীতি গ্রহণ করেছিল

Asia for Asians—স্লোগানের মাধ্যমে জাপান পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে পূর্ব এশিয়ার ত্রাতা হিসেবে নিজেকে সামনে আনার চেষ্টা করে। জাপানের এই স্লোগান প্রচারের কয়েকটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যগুলি হল—

এশীয়রাই এশিয়া শাসনের অধিকারী : ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ ঘোষণার অর্থ ছিল যে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেসব ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল, তার অবসান ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ। জাপানের মতে, একমাত্র এশীয়রাই এশিয়া শাসন করার অধিকারী। এই নীতির দ্বারা জাপান প্রবল বিক্রমে এশিয়া থেকে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজে নেমে পড়ে।

বৃহৎ জাপানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা : ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ ঘোষণা ছিল জাপানের একটি ছলনা মাত্র। এর আড়ালে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা বিস্তার করা। জাপানের সমকালীন প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর প্রকৃত বক্তব্য ছিল ‘এশিয়া কেবল জাপানেরই জন্যই’ এবং জাপানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটি বৃহৎ জাপানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

এশিয়ার দেশগুলিকে উৎসাহ দেওয়া : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান পাশ্চাত্যের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে বিপুল সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পশ্চিমি দেশগুলির বিরুদ্ধে এশিয়ার দেশগুলির যুদ্ধ প্রয়াসকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যেও জাপান ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলন’ (১৯৪৩)-এ এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া নীতি ঘোষণা করে।

যুদ্ধনীতির অঙ্গ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব এশিয়ায় জাপানের যুদ্ধনীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করে সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার : পশ্চিমি দেশগুলি পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করে তা নিজেদের দেশে নিয়ে যেত। এসব সম্পদ ও কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে সেখানে শিল্পের বিকাশ ঘটে। জাপান মনে করত যে, এশীয়দের পক্ষে পশ্চিমিদের একাজ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ একমাত্র এশীয়দেরই পূর্বা এশিয়ার ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার আছে। এখানে পশ্চিমিদের কোনো অধিকারই নেই।

উপরি-উক্ত উদ্দেশ্যে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালে ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ নীতি গ্রহণ করে।

মূল্যায়ন : উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে জাপানে দ্রুত আধুনিকীকরণ ঘটলে জাপান পশ্চিমি শক্তিগুলির সমকক্ষ হয়ে পড়েছিল। তার ফলশ্রুতিতে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ক্রমশ পল্লবিত হয়ে ওঠে। ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ নীতি সেই মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ে তাদের আগ্রাসী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত