ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি কী ছিল? ভারতীয়রা কেন এগুলিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?

(উত্তর) ক্রিপস মিশন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতেও জাপানের আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-কে ভারতে পাঠান। তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ দিল্লিতে পৌঁছোন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে ক্রিপসের এই ভারত-আগমন ‘ক্রিপস দৌত্য’ বা ‘ক্রিপস মিশন’ নামে পরিচিত।

ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবসমূহ

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনার পর তাঁদের কাছে ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাব ‘ক্রিপস প্রস্তাব’ নামে পরিচিত। প্রস্তাবগুলি নিম্নরূপ : 

  1. যুদ্ধের পর ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন’-এর মর্যাদা দেওয়া হবে। 
  2. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে। 
  3. সংবিধান সভার সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
  4. দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় রাজাদের দ্বারা মনোনীত হবেন।
  5. উল্লিখিত সংবিধান সভা ভারতের নতুন সংবিধান রচনা করবে। 
  6. ভারতের কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য এই সংবিধান গ্রহণে রাজি না হলে সেই প্রদেশ  বা দেশীয় রাজ্য নিজের সংবিধান রচনা করবে। 
  7. সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে।
  8. ভারতীয়দের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করবে।

ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া ও ভারতীয়দের দ্বারা প্রত্যাখানের কারণ

ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কেবল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ ক্রিপস প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। ক্রিপস প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের বিরোধিতার একাধিক কারণ ছিল। যথা –

  • untickedকংগ্রেস কেন প্রতাখ্যান করে :
  1. ক্রিপস প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তাছাড়া প্রদেশগুলিকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার দিয়ে পরোক্ষে মুসলিম লিগের পৃথক পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করা হয়।
  2. এই প্রস্তাবে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। এমনকি ওই প্রস্তাবে ভারতকে দ্রুত স্বাধীনতা দানের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।
  3. কংগ্রেস চেয়েছিল অতি দ্রুত শাসন ক্ষমতা লাভ। এজন্য গান্ধিজি এই প্রস্তাবকে ‘একটি ফেলপড়া ব্যাংকের’ চেকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি ‘হরিজন’ পত্রিকায় ক্রিপস প্রস্তাবকে ‘দুর্ভাগ্যজনক প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করেন।
  • untickedঅন্যান্যদের বিরোধিতার কারণ :
  1. ক্রিপস প্রস্তাবে মুসলিমদের জন্য পৃথক পাকিস্তানের কোনো সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি ছিল না বলে ‘মুসলিম লিগ’ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
  2. শিখ সম্প্রদায় এই কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে, যদি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব প্রদেশ ভারত ইউনিয়নে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে যোগ দেয়, তবে শিখদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
  3. হিন্দু মহাসভা আশঙ্কা করেছিল যে, ক্রিপস প্রস্তাবের ফলে ভারত বিভাজনের সম্ভাবনা রয়েছে।
  4. অনুন্নত সম্প্রদায়গুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল কারণ, ক্রিপস প্রস্তাবের ফলে ভারতে বর্ণহিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
  • untickedপ্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের মর্মার্থ উপলব্ধি করে অচিরেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। জওহরলাল নেহেরু বলেছেন, এই প্রস্তাব দেখে তিনি ভেঙে পড়েন। এককথায় এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়।
error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত