১৯৪২ খ্রি. ভারত ছাড়ো আন্দোলন একটি নিবন্ধ লেখ।

(উত্তর) সূচনা : ক্রিপস প্রস্তাব ব্যর্থ হলে ভারতীয় জনমানসে তীব্র অসন্তোষের জন্ম নেয় এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ এপ্রিল গান্ধিজি ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রথমে ‘ভারত ছাড়ো’ পরিকল্পনা পেশ করেন। এরপর কংগ্রেস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ওয়ার্ধায় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এবং পরিশেষে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় ৮ আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

ব্রিটিশ সরকারকে কংগ্রেস জানিয়ে দেয় যে, ব্রিটিশরা স্বেচ্ছায় ভারত না ছাড়লে কংগ্রেস আর দেরি না করে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করবে। গান্ধিজি ধ্বনি তোলেন—“করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” অর্থাৎ “আমরা ভারত স্বাধীন করব অথবা মরব।”

প্রাথমিক দমননীতির প্রয়োগ : ভারত ছাড়ো আন্দোলন ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার গান্ধিজি, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখ নেতাদের গ্রেপ্তার করে। জাতীয় কংগ্রেস ও তার সব শাখাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। ‘হরিজন’ পত্রিকা-সহ অন্যান্য কয়েকটি পত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

আন্দোলনের প্রসার ও প্রকৃতি

  1. আন্দোলনের সূত্রপাত : নেতাদের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দেশজুড়ে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল শুরু হল।
  2. হিংসার পথ গ্রহণ : আন্দোলন ক্রমে সহিংস পথে অগ্রসর হতে শুরু করে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কাটা, রেললাইন উপড়ে ফেলা, সেতু ধ্বংস করা, রেলস্টেশন, ডাকঘর, থানা ও সরকারি অফিস-আদালতে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি চলতে থাকে। স্কুলকলেজ, হাসপাতাল ও বিভিন্ন কোম্পানিতে ধর্মঘট শুরু হয়।
  3. আন্দোলনের ব্যাপকতা : বাংলার তমলুক ও বালুরঘাট, বিহারের পাটনা, ভাগলপুর ও জামসেদপুর, উড়িষ্যার তালচর, আসামের নওগাঁ, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া ও আজমগর, মহারাষ্ট্রের সাতার, দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজ, কেরালার কালিকট, মহীশূরের ব্যাঙ্গালোর প্রভৃতি স্থানে আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লি, কানপুর, লক্ষ্ণে, নাগপুর, আমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে ইংরেজ ফৌজের রক্তাত্ত সংঘর্ষ চলে।
  4. আন্দোলন পরিচালনা : জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া, অরুণা আসফ আলি, অচ্যুত পট্টবর্ধন, নরেন্দ্র দেব, সুচেতা কৃপালনী প্রমুখের নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে।
  5. বাংলায় আন্দোলন : বাংলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কলকাতা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মেদিনীপুর জেলা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সরকারের সর্বাধিনায়ক ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত।
  6. গণবিপ্লব : ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে গণবিপ্লব। এই আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের অংশগ্রহণের ফলেই আগস্ট আন্দোলন দুর্দমনীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই আন্দোলনকে  ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির মতে, এই আন্দোলন ছিল ‘গণযুদ্ধ’।

আন্দোলনকারীদের ভূমিকা

কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সফল হয়েছিল। নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়বার মতন। অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনী প্রমুখ নেত্রী গোপনে মেয়েদের সংগঠিত করেন। গান্ধি বুড়ি নামে পরিচিত ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনি হাজরা তমলুকের সরকারি অফিসে জাতীয় পতাকা তুলতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তবে অধিকাংশ মুসলিম সম্প্রদায় এই আন্দোলনে তেমন যোগদা করেনি।

চূড়ান্ত দমননীতি

আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার নিষ্ঠুর দমননীতি গ্রহণ করে। গুলিচালনা, গ্রেপ্তার, জরিমানা, লাঠিচালনা, বেতের আঘাত এমনকি বিমান থেকে গোলাবর্ষণও করা হয়। সারা দেশে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর তান্ডব শুরু হয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ক্রমে ভয়াবহ আকার ধারণ করলে সরকারি দমননীতিও তীব্র হয়ে ওঠে। খুন, ধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনা নির্বিচারে চলতে থাকে।

আন্দোলনের অবসান

ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রায় বছর ধরে চলে। কিন্তু ব্রিটিশ তীব্র দমননীতির ফলে আন্দোলন তার গতি হারিয়ে ফেলে। ১৯৪৩ সালের  ফেব্রুয়ারির মধ্যে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে গান্ধিজি জেল থেকে পান এবং আন্দোলন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন।

আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পিছনে যেসব কারণ ছিল সেগুলি হল—

  1. তীব্র দমননীতি প্রয়োগ : আন্দোলনের শুরু থেকেই ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর নিষ্ঠুর ও অমানবিক দমননীতি চালাতে শুরু করে।
  2. নেতৃত্বের অভাব : আন্দোলনের শুরুতেই সরকার দেশের প্রথম সারির অধিকাংশ নেতাকে গ্রেপ্তার করায় জনসাধারণ সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছিল। 
  3. গান্ধিজির অনুপস্থিতি : আন্দোলনের শুরুতেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান কান্ডারি গান্ধিজি গ্রেপ্তার হন। আন্দোলন পরিচালনার বিষয়ে গান্ধিজির অনুপস্থিতি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ব্যর্থ করে তুলেছিল। 
  4. মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা : মুসলিম লিগ ও মুসলিম সম্প্রদায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখায় এই আন্দোলন প্রকৃত গণ-আন্দোলন হয়ে উঠতে পারেনি।

আন্দোলনের গুরুত্ব

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্বগুলি হল :

  1. সর্বস্তরের মানুষের যোগদান : ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সরকারের বিরোধিতায় গণ-আন্দোলনে অংশ নেয়।
  2. কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি : কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব ব্যাপক হয়।
  3. স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুতি : ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য তারা সব ধরনের ত্যাগ, অত্যাচার এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত।
  4. বিভিন্ন দলের ওপর প্রভাব : ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক প্রভাব ফেলেছিল। এই আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে শুভ হয়েছিল। অন্যদিকে আন্দোলনের প্রতি বামপন্থী দলগুলির নেতিবাচক মনোভাবের ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যায়।
error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত