ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান পর্যালোচনা করো।

(উত্তর) সূচনা : ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসু যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তার তুলনা বিশ্ব-ইতিহাসে খুবই বিরল। বিশিষ্ট দেশপ্রেমিক হরিবিষ্ণু কামাথ তাঁকে শিবাজী, জর্জ ওয়াশিংটন, গ্যারিবল্ডি ও কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের গভীর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও প্রবল সংগ্রামের কাহিনি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে। সুখের সরকারি চাকরিকে অবহেলায় পরিত্যাগ করে সুভাষচন্দ্র যেভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুবই বিরল।

সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবন : আই.সি.এস পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখেন সুভাষচন্দ্র বসু। কংগ্রসের মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও পরবর্তীকালে এই দল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯-এর কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও গান্ধিজির সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে কংগ্রেস ত্যাগ করে “ফরোয়ার্ড ব্লক” দল গঠন করেছিলেন। যাইহোক দেশকে স্বাধীন করতে তিনি অহিংসার পরিবর্তে হিংস্রতাকেও সমর্থন জানাতে পিছপা হননি।

স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে সুভাষচন্দ্র : সুভাষচন্দ্র বসু তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৈদেশিক শক্তির সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এইসময় সরকার আতঙ্কিত হয় যে, বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে সুভাষচন্দ্র ভারতে ব্যাপক ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। এজন্য যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪০ খ্রি. ব্রিটিশ সরকার সুভাষচন্দ্রকে গ্রেফতার করে ও গৃহবন্দি করে রাখে । কিন্তু সুভাষচন্দ্র ছদ্মবেশে সশস্ত্র পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান ১৯৪১ খ্রি. এবং কলকাতা থেকে পালিয়ে আফগানিস্তানের পথে সোভিয়েত রাশিয়ায় পৌঁছোন।

সুভাষচন্দ্রের জার্মানি গমন : রাশিয়ার সাহায্য লাভে বিফল হয়ে সুভাষচন্দ্র জার্মানিতে গিয়ে হিটলার ও মুসোলিনির প্রতিশ্রুতি আদায়ে তৎপর হন। হিটলার ও মুসোলিনি তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বতোভাবে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি দেন।

 জার্মান সরকারের সহযোগিতায় বার্লিনে প্রতিষ্ঠিত বেতারকেন্দ্র থেকে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতে থাকেন সুভাষচন্দ্র। এরপর জার্মানির হাতে বন্দি ৪০০ ভারতীয় সৈন্যকে নিয়ে সুভাষচন্দ্র ১৯৪২ খ্রি. “Free India Legion” নামে এক সেনাদল গঠন করেন। এই সেনাদল সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সর্বপ্রথম তাঁকে ‘নেতাজি’ অভিধায় ভূষিত করে এবং ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানায়।

আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রখ্যাত ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সক্রিয় ছিলেন। তিনি ‘পূর্ব এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জনক’ নামে পরিচিত। তাঁর সভাপতিত্বে ব্যাংককে প্রবাসী দেশপ্রেমিক ভারতীয়রা ১৯৪২ খ্রি. ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ’ গঠন করে। রাসবিহারী বসু ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন। এই সেনাদল প্রতিষ্ঠার সময় মোহন সিং ছিলেন এর প্রধান সেনাপতি। ঐক্য, আত্মবিশ্বাস ও আত্মোৎসর্গ – এই তিনটি আদর্শের ভিত্তিতে এই সেনাদল ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালায়।

সুভাষচন্দ্রের জাপান গমন : সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানি থেকে সাবমেরিনে সমুদ্রপথ অতিক্রম করে জাপানের রাজধানী টোকিওতে হাজির হন রাসবিহারী বসুর আহ্বানে। সুভাষচন্দ্রের আগমনে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয়দের মনে প্রবল উদ্দীপনা দেখা দেয়।

আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ : রাসবিহারী বসু ১৯৪৩-এ সিঙ্গাপুরে এক বিশাল জনসভায় সুভাষচন্দ্রের হাতে “ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ”-এর যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দেন। সুভাষচন্দ্র ২৫ আগস্ট “আজাদ হিন্দ বাহিনী”র নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীকে তিনি কয়েকটি ব্রিগেডে ভাগ করেন – গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড, ঝাঁসির রানি ব্রিগেড, বাল সেনাদল প্রভৃতি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর অন্যতম সেনাধ্যক্ষ ছিলেন শাহনওয়াজ খান।

আজাদ হিন্দ সরকারের অবদান : নেতাজি সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ খ্রি. সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ নামে স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। এই সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কয়েকদিনের মধ্যেই জাপান, জার্মানি, থাইল্যান্ড, ইতালিসহ কয়েকটি দেশ আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন। নেতাজি এই দুটি দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন যথাক্রমে ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’। আজাদ হিন্দ বাহিনী এরপর ভারত অভিযানে অগ্রসর হয়। সেনাদলের সামনে নেতাজি ধ্বনি দেন “দিল্লি চলো”।

আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালায়। তারা মণিপুরের কোহিমা শহরটি দখল করে ৬ এপ্রিল, ১৯৪৪ খ্রি. জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং রাজধানী ইম্ফল দখলের জন্য অগ্রসর হয়। আজাদ হিন্দ বাহিনী অভিযান চালিয়ে ভারতের সীমানা থেকে প্রায় ১৫০ মাইল অভ্যন্তর পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করতে সক্ষম হয়।

আজাদ হিন্দ বাহিনীর পরাজয় : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আমেরিকার নিকট কোণঠাসা হলে ও পিছু হঠলে আজাদ হিন্দ সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়। জাপানের প্রত্যাবর্তনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এছাড়া খাদ্যাভাব, প্রবল শীত, ম্যালেরিয়া, পার্বত্য অঞ্চলের বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় প্রভৃতি কারণে কয়েক হাজার আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনার মৃত্যু হয়। শেষপর্যন্ত জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারাও অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

কথিত আছে, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট তাইহোকু-র এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়। কিন্তু এই কাহিনির সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন।

সুভাষচন্দ্র পরিচালিত আন্দোলনের গুরুত্ব

ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবল বিক্রমের দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ বাহিনী এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। 

  1. আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ১৫০ মাইল অভ্যন্তর পর্যন্ত অঞ্চল স্বাধীন করতে সক্ষম হয়।
  2. ব্যর্থতা সত্ত্বেও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা যুদ্ধে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তাতে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, ভারতে তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
  3. আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দেশবাসীর মনে প্রবল জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।
  4. আজাদ হিন্দ বাহিনীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কিছুকাল পরে ভারতে নৌবিদ্রোহ ঘটে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবল অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
  5. গান্ধিজি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রকে “প্রথম ভারতীয় ও শেষ ভারতীয়” বলে বর্ণনা করেন।

উপসংহার : মাতৃভূমির উদ্ধারে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সেনারা যেরূপ আত্মবলিদান দিয়েছিল তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। মণিপুরের মৈরাং গ্রামেই আজাদ হিন্দ সেনাদের উদ্যোগে সর্বপ্রথম ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৪ তারিখে ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেছিল। সুভাষচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গান্ধিজি বলেছেন, “আজাদ হিন্দ ফৌজ আমাদের সম্মোহিত করেছে। নেতাজির নাম আমাদের জাদুমুগ্ধ করে।”

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত