ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো এবং এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

(উত্তর) আন্দোলনের সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আগত ‘ক্রিপস মিশন’ ব্যর্থ হলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়। ১৯৪২ খ্রি. ২৬ এপ্রিল গান্ধিজি তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রথম “ভারত ছাড়ো” পরিকল্পনা পেশ করেন এবং ঐ বছরের ওয়ার্ধা কংগ্রেসে আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই আন্দোলনে গান্ধিজির সেই বিখ্যাত শ্লোগান মুখরিত হয়, “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে”। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড়ো গণ-আন্দোলন। এই আন্দোলনের নানামুখী তাৎপর্য লক্ষ করা যায়। 

আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

ভারত ছাড়ো আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় ঠিকই কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। এই আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্বগুলি হল – 

(১) সর্বস্তরের মানুষের যোগদান : ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে এই গণ-আন্দোলনে অংশ নেয়। জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে তাঁর গ্রন্থে এই আন্দোলনকে একটি জাতীয়তাবাদী গণ-আন্দোলন বলেছেন।

(২) কগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি : ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪২-এর আন্দোলন হল চূড়ান্ত পর্যায়। কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব ব্যাপক হয় এবং এই আন্দোলনের দ্বারা কংগ্রেস দেশবাসীর ওপর তার প্রতিপত্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়।

(৩) স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুতি : ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত। অরুণচন্দ্র ভূঁইয়া তাঁর “The Quit India Movement’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই আন্দোলনের ফলে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এর ফলে ইংরেজরা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। ড. অম্বাপ্রসাদ বলেন যে, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে।

(৪) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার : মুসলিম লিগ এই আন্দোলনে যোগ না দিলেও বহু মুসলিম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন ও সহায়তা করে। মুসলিম লিগের বিরোধিতা সত্ত্বেও বহু স্থানের বহু মুসলিম এই আন্দোলনে অংশ নেয় এবং আন্দোলনে নানাভাবে সহায়তা করে।

(৫) ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি : তৎকালীন বড়োলাট ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়েছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, মুক্তিসংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য।

(৬) বিভিন্ন দলের ওপর প্রভাব : ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক প্রভাব ফেলেছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। এই আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে শুভ হয়েছিল এবং এতে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল। অন্যদিকে আন্দোলনের প্রতি বামপন্থী দলগুলির নেতিবাচক মনোভাবের ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যায়।

মহিলাদের অংশগ্রহণ 

নারীদের সক্রিয় যোগদান : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারত ছাড়াে আন্দোলন শুরু হলে সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মতাে নারী সমাজও অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারী সমাজের এই অংশগ্রহণ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৭ আগস্ট, ভারতছাড়াে প্রস্তাব, গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় স্তরের প্রায় সমস্ত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলেও এই আন্দোলন সচল ছিল। সুচেতা কৃপালিনী, নন্দিতা কৃপালিনী, অরুণা আসফ আলি নারীদের সংগঠিত করে এই আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন। ভারতছাড়াে আন্দোলনে বাংলার নারীদের ভূমিকাও গৌরবজনক ছিল।

বিভিন্ন কর্মকাণ্ড : মেদিনীপুরে ‘তাম্রলিপ্ত’ জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সরকারের সঙ্গে যুক্ত নারীরা ভগিনী সেনা গঠন করেছিলেন। কৃষক পরিবারের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে ‘গান্ধি বুড়ি’ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। এছাড়া লাবণ্যপ্রভা দত্ত; এলা দত্ত, সুনিতা সেন, মায়া ঘােষ প্রমুখের অংশগ্রহণ ভারতছাড়ো আন্দোলনকে সুগঠিত করেছিল। এছাড়া আসাম ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে কিশােরী কনকলতা বড়ুয়া ভােগেশ্বরী ফুকোননী, উষা মেহতা প্রমুখ আন্দোলনকে সক্রিয় করে রেখেছিলেন। উষা মেহতা বেতার মাধ্যমে এই আন্দোলনকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

উর্মিলা দেবী ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করে বিদেশি দ্রব্য বর্জন, পিকেটিং, স্বদেশী প্রচার, চরকা প্রচলন ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিলেন। এছাড়া সন্তোষ কুমারী দেবী তৎকালীন চটকল ধর্মঘট শ্রমিক আন্দোলন চা-বাগানে ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভারতছাড়াে আন্দোলনে সমাজের নিম্নশ্রেণির মহিলারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মাতঙ্গিনী দেবী তার উজ্জ্বল উদাহরণ। এইভাবে সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মতাে নারীসমাজ ভারতছাড়াে আন্দোলনের মতাে গণ-আন্দোলনে তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন এবং যার ফলে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।

আন্দোলনের প্রকৃতি : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের সক্রিয় ভূমিকা বেশ জোরালোভাবে চোখে পড়ে। এই পর্বে মহিলারা দুটি ভিন্ন ধারায় আন্দোলন করেছিলেন।

  1. শহরাঞ্চলে মেয়েরা ধর্মঘট, প্রতিবাদসভা, এমনকি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল।
  2. অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে কর বৃদ্ধি, জমিদারী শোষণ, পুলিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেয়।

কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা কারারুদ্ধ হলে কিছু বিখ্যাত মহিলা নেত্রী নজিরবিহীনভাবে পুলিশি অত্যাচারের মুখে আন্দোলন সুসংবদ্ধ ভাবে পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।

ঊষা মেহতা বম্বেতে গোপন বেতার বার্তা চালু করেন যার নাম ছিল ‘ভয়েস অফ ফ্রিডম’। কারণ ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের অধিকার খর্ব করলে ঊষা মেহতা গোপনে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিদ্রোহের খবর প্রচার করেছিলেন । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১২ ই নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন।

অন্যদিকে গান্ধীজীর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে সুচেতা কৃপালনী সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন । ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন কংগ্রেসের মহিলা বিভাগের নেত্রী হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে আন্দোলনের বার্তা এবং নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেছিলেন । তাকে গ্রেপ্তার করে লখনউ জেলে একজন ‘dangerous prisoner’ হিসেবে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।

আসামের গোহপুর থানায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে প্রাণ হারান কনকলতা বড়ুয়া। পাঞ্জাবে রাজকুমারী অমৃত কাউর, অমর কাউর, পুষন গুজরাল সম্মিলিতভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেন । এছাড়া অসীম সাহসের পরিচয় দেন ভোগেশ্বরী ফুকননী।

বাংলায় আন্দোলন ও গান্ধিবুড়ি : তমলুকে জাতীয় সরকার নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন যার নাম হয় ‘ভগিনী সেনা। এই দলে ছিলেন কাদম্বিনী মাইতি, সুরাইয়া সুন্দর মাইতি, কুসুমবালা দেবী, রাধারানী পাত্র। মেদিনীপুরের বেশ কিছু জায়গায় মূলত তমলুকে খাজানা বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জনসাধারণ পুলিশ চৌকি আক্রমণে উদ্যত হয় । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৯ শে সেপ্টেম্বর তমলুকের কিছু আন্দোলনকারী থানা ঘেরাও করতে অগ্রসর হয় । সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী তাদের বাধা দেয়। এই সময়ে ৭৩ বছরের বিধবা নারী মাতঙ্গিনী হাজরা এগিয়ে এসে পতাকা তুলে নেন এবং এবং জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন আন্দোলনকারীদের এগিয়ে যেতে বলেন। পুলিশের বাধা এড়িয়ে এগোতে গেলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান মাতঙ্গিনী হাজরা।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাঁকুড়ার শান্তিশীলা পালিত, ঢাকার আশালতা সেন, বালুরঘাটের প্রভা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীহট্টের সরলাবালা দেবী, নোয়াখালীতে সুশীলা মিত্র, সিউড়িতে লাবণ্যপ্রভা দত্ত,কুমিল্লায় মায়া ঘোষ প্রমুখরা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

আইন অমান্য আন্দোলন কালে দেখা গিয়েছিল পুরুষ সদস্যরা ডান্ডি পৌঁছানো পর্যন্ত মহিলাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। ডান্ডি পৌঁছনোর পর তাদের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে সংগ্রাম এবং প্রতিরোধ চালিয়েছে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত