(উত্তর) সূচনা : কোচিন-চিন, লাওস, কম্বোডিয়া, আন্নাম ও টং কিং—এই কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ইন্দোচিনে উনিশ শতকে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি আগ্রাসনে ফ্রান্স পর্যুদস্ত হলে এশীয় দেশ জাপান ইন্দো-চিনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে।
ভিয়েতমিন : দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলে ইন্দোচিনবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জাগরণ ঘটে। এই জাগরণের মন্ত্রগুরু ছিলেন সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা হো-চি-মিন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘লিগ ফর দ্য ইনডিপেনডেন্স ইন ভিয়েতনাম’, যার সংক্ষেপিত নাম ‘ভিয়েতমিন’।
ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিয়েতমিন নেতা হো-চি-মিন টংকিং-এর সাতটি প্রদেশে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হ্যানয় নামে স্থানটিও দখল করে সেখানে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্থাপন করেন।
ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় (১৯৪৫-৫৪ খ্রি:)
দ্বিখণ্ডিত ইন্দো-চিন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর ‘পটসডাম সম্মেলনে’র সিদ্ধান্ত মেনে ১৭ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুটি ভাগে বিভক্ত করে। উত্তরাংশে হো-চি-মিনের শাসন এবং দক্ষিণাংশে ফরাসি আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়।
ফরাসি আক্রমণ : ফ্রান্স কেবলমাত্র দক্ষিণ ইন্দো-চিন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি ছিল না, অপরদিকে হো-চিন-মিন চেয়েছিলেন অখণ্ড ভিয়েতনামের পূর্ণ স্বাধীনতা। এরূপ প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স উত্তর ভিয়েতনামে বোমা বর্ষণ করলে প্রায় ৬ হাজার অসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়—শুরু হয় ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়।
ভিয়েতমিনের প্রতিরোধ : টানা আট বছর ধরে পৈশাচিক দমন-পীড়ন চালিয়েও ফ্রান্স ভিয়েতমিনদের পদানত করতে ব্যর্থ হয়। উত্তর ভিয়েতনামে হো-চি-মিন-এর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি জানায় চিন, সোভিয়েত রাশিয়া সহ বিভিন্ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। আবার মার্কিন সাহায্যপুষ্ট হয়েও ফরাসি বাহিনী ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিক থেকে ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকে।
দিয়েন-বিয়েন-ফু-র ঘটনা : ভিয়েতমিনদের সম্পূর্ণরূপ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ফরাসি সেনাপতি নেভারে এক নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা ‘নেভারে প্ল্যান’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনানুসারে টংকিং-এর দিয়েন-বিয়েন-ফু গ্রামে একটি অস্ত্রভাণ্ডার ও দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তৈরি করেন। কিন্তু ভিয়েতমিন সেনাপতির সময়োচিত আক্রমণে ফরাসি প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। প্রায় ৫৭ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর প্রায় ১৫ হাজার ফরাসি সেনা ভিয়েতমিনদের হাতে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনার পর ফ্রান্স উত্তর ভিয়েতনাম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।
জেনিভা সম্মেলন : দিয়েন-বিয়েন-ফু-তে ফরাসি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিনই (৮ মে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ) ইন্দোচিন সমস্যার সমাধানকল্পে সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ভিয়েতনামকে সাময়িকভাবে পুনরায় দ্বিখণ্ডিত করে উত্তর ভিয়েতনামে ভিয়েতমিন এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিপুঞ্জের তদারকি কমিশনের মাধ্যমে ভিয়েতনামে স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনা প্রভৃতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫৬-৭৬ খ্রি:)
জেনিভা সম্মেলনের ব্যর্থতা : জেনিভা সম্মেলনে ভিয়েতনাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি, বরং বলা যায়, জেনিভা চুক্তিতে ভিয়েতনাম সমস্যার একটি অধ্যায় সমাপ্ত হয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
দিয়েম সরকারের পতন : স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত দিয়েম সরকারের বিরুদ্ধে সমগ্র ইন্দোচিন জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মার্কিন ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাহিনী একজোট হয়ে উত্তর ভিয়েতনাম আক্রমণ করলে গোটা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে।
স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামের আত্মপ্রকাশ : সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন শক্তি ভিয়েতনামে পৈশাচিক দমন-পীড়ন চালালেও শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনামবাসীর ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কাছে তারা মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনাম ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে হো-চি-মিন-এর স্বপ্নের সমাজতন্ত্র।
মূল্যায়ন : ভিয়েতনামের যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে নিঃসন্দেহে মহিমান্বিত করেছে। মার্কিন শক্তি এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে তার সম্মান ও প্রতিপত্তি অনেকটাই খুইয়ে ছিল।