বাংলায় ১৯৪৩ খ্রি. দুর্ভিক্ষের কারণগুলি কী ছিল? এই ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা কী ছিল?

(উত্তর) ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের ফলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৫০ বঙ্গাব্দে সংগঠিত হয়েছিল বলে এই দুর্ভিক্ষ “পঞ্চাশের মন্বন্তর” নামে পরিচিত। অনুমিত হয়, এই দুর্ভিক্ষে বাংলার অন্তত ৪০ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। 

পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ

বিভিন্ন তথ্য বিচার করে পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিভিন্ন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। কারণগুলি নিম্নরূপ : 

  • খাদ্য উৎপাদন হ্রাস : ঘূর্ণিঝড়, শস্যে মড়ক প্রভৃতি কারণে বাংলায় খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। বিশেষ করে আমন ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বলে বাংলায় খাদ্যসংকট চরমে ওঠে।
  • জাপানের ভারত আক্রমণের আশঙ্কা : ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিল যে, জাপান ভারত আক্রমণ করতে পারে। এই জন্যে ব্রিটিশ সরকার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন, সীমান্ত অঞ্চলে পোড়ামাটি নীতি ঘোষণা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া প্রভৃতি। এইসব কারণে বাংলায় খাদ্যসংকট অচিরেই দেখা দিয়েছিল।
  • চার্চিলের ভূমিকা : লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জি পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে দায়ী করেছেন। জাহাজ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে বাংলায় কোনো খাদ্য আনার ব্যবস্থা করেননি। শুধু তাই নয়, বাংলায় খাদ্য পাঠানোর পরিবর্তে গ্রিসে খাদ্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন চার্চিল। চার্চিলের এই রূপ অমানবিক আচরণের ফলে দুর্ভিক্ষের সময় বাংলায় খাদ্য আমদানি করা যায়নি।
  • সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানি : ভারতবর্ষে কিছু পরিমাণ খাদ্য বাইরে থেকে আমদানি করতে হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য বাইরে পাঠায় সেনাদের জন্য। এর ফলে দেশে খাদ্যসংকট আরো বৃদ্ধি পায়।
  • খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি : যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কম খাদ্য উৎপাদন, ব্যাবসায়ীদের খাদ্যশস্য মজুতদারি প্রভৃতির ফলে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। তাই সাধারণ মানুষজন উচ্চমূল্যে খাদ্য কিনতে অসমর্থ ছিল।
  • সরকারের অবহেলা : দুর্ভিক্ষের পূর্বেই খাদ্যসংকটের সতর্কবার্তা সরকার গ্রাহ্য করেনি। নিয়মমাফিক দায়িত্ব পালন না করায় বাংলার দুর্ভিক্ষ ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল।

ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা

পঞ্চাশের মন্বন্তরের মোকাবিলায় সরকারের যে সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব ছিল, তা সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। যেমন –

  1. সতর্কবার্তায় নিশ্চেষ্ট থাকা : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নেতা ফজলুল হক সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও আগে থেকেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বাংলার সরকারকে জানালেও সরকার তাতে আদৌ কর্ণপাত করেনি।
  2. সরকারের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি : সরকার মনে করত যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলায় খাদ্যের কোনো সংকট নেই। খাদ্যের মজুতদারিই বাংলার দুর্ভিক্ষের একমাত্র কারণ। তাই দুর্ভিক্ষ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখনও সরকার প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল।
  3. মজুতদারি বন্ধে সরকারি উদ্যোগের অভাব : মজুতদারি বন্ধ করতে বা গুদামে মজুত করা খাদ্য বাজারে ছাড়তে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করতে সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
  4. বাংলার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন আচরণ : ইতিপূর্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের সময় সরকার বাইরে থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ করত এবং দুর্ভিক্ষপীড়িতদের অর্থ সাহায্য করত। কিন্তু পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় সরকার বাংলায় অনুরূপ দায়িত্ব পালন করেনি।
  5. সরকারের তৎপরতার অভাব : ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্যসংকট শুরু হলে বাংলার প্রাদেশিক সরকার এর মোকাবিলায় মোটেই তৎপরতা দেখায়নি। যখন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় সরকার তখন অতি ধীর গতিতে ত্রাণকার্য শুরু করে।
  6. গ্রামকে বঞ্চনা : দুর্ভিক্ষের সময় সরকার কয়েকটি শহরে ন্যায্য মূল্যের সামান্য কয়েকটি দোকান খুললেও গ্রামগুলি এ ধরনের কোনো সুবিধা পায়নি।
  7. দুর্নীতির ক্ষতিকারক প্রভাব : পদস্থ কর্মচারীদের দুর্নীতি ও জালিয়াতি দুর্ভিক্ষকে তীব্রতর করে তুলেছিল।
  8. সামরিক কারণে রেলের ব্যস্ত থাকা : সরকার এই সময় সামরিক কাজের সঙ্গে যুক্ত লোকজন ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতের রেলব্যবস্থাকে বেশি করে কাজে লাগায়। ফলে রেলের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হয়।

যাইহোক, এই দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলার লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র মানুষ। বিদেশ থেকে আসা সামান্য সহায়তা মন্বন্তরে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। অর্থাৎ স্পষ্টতই ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব এই পঞ্চাশের মন্বন্তরকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তয়ের ভয়াবহতা ব্যাপক বিক্রিত দিল। বাংলার এই দুরভিক্ষের চিত্রচি ছিল করুন। এই চরতিক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল গুলি দিল-

  1. মৃত্যুর মিছিল : পঞ্চাশের মন্বন্তরের গ্রাম বাংলায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হায়দিন। মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সিটিস সরকার প্রকাশ না করলেও অন্তত্য চল্লিশ থেকে সত্তর লক্ষ্য মানুষের মৃত্যু হয়েদিন।
  2. অর্থনৈতিক বিপর্যয় : এই সময়ে বাংলার তঅভিক্যাংশ নানুষের জীবনে আর্থিক বিপর্যয় গেমে আসে। সঞ্চিত অর্থ স্মরচের পর দরিদ্র মানুষ গুলি সাদ্যের সন্ধানে ভিক্ষা গ্র কমিশন গঠন! বাস্তায় বেরিয়ে পরে।
  3. শিল্প সাহিত্য : পঞ্চাশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাহিত্য শিলা সৃষ্টি হয়েদিন যেমন নবান্ন (বিজন ভট্টাচার্য), শুক্ত অসনিসংকেত (বিভূতি ভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়), আলালের সন্ধানে (অমেলেন্দু চক্রবর্তী) প্রভৃতি এছাড়াও রয়েছে সিনেমা চিত্রকলা।
  4. গ্রন্থ নিষিদ্ধকরণ : চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ক্ষুদার্থ বাংলা বইটি প্রকাশের সঙ্গো সঙ্গে নিসিদ্ধ হয়েছিল। বইটিতে হরভিক্ষের জন্যে ব্রিচিস সরকারকে দ্বায়িকরা হয়। বর্তমানে দিল্লির অর্টি গ্যালারিতে একটি বই রামা আছে।
error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত