১৯৩৫ খ্রি. ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপট ও শর্তাবলি আলোচনা করো। এই আইনের গুরুত্ব কী ছিল?

(উত্তর) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন : ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে যে ‘ভারত শাসন আইন’ প্রবর্তন করেছিল ভারতীয় ইতিহাসে তার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত এই আইন ১৯৩৭ সালে কার্যকরী হবে বলে জানানো হয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারতশাসন আইন প্রণয়নের বিভিন্ন কারণ ছিল। এগুলি নিম্নে আলোচিত হল।

আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপট

(১) গণ-আন্দোলন : ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের “মন্ট-ফোর্ড আইন” ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা ভারতে প্রবল গণ-আন্দোলন শুরু হয়। 

(২) বিপ্লবী কার্যকলাপ : এই সময় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীদের অতিসক্রিয়তায় সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।

(৩) জাতীয়তাবাদের প্রভাব : ভারতে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার চিন্তা করতে শুরু করে।

(৪) সাইমন কমিশনের রিপোর্ট : ভারতীয়রা স্বায়ত্তশাসন লাভের উপযুক্ত কিনা তা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে যে “সাইমন কমিশন” ভারতে এসেছিল; ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে। তাতে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর সুপারিশ করে।

(৫) গোলটেবিল বৈঠক : ব্রিটিশ সরকার প্রথম (১৯৩০ খ্রি.), দ্বিতীয় (১৯৩১ খ্রি.) ও তৃতীয় (১৯৩২ খ্রি.) গোলটেবিলের বৈঠকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সাংবিধানিক সংস্কার প্রবর্তনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হয়।

(৬) শ্বেতপত্র : সরকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতের সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবসমূহ নামে একটি ‘শ্বেতপত্র’ (White Paper) প্রকাশ করেছিল। এইসব প্রস্তাব এবং যৌথ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত শাসন আইন’ পাস করে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের শর্তবলী

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের বিভিন্ন ধারাগুলিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায় – ‘কেন্দ্রীয় সরকার সংক্রান্ত’ এবং ‘প্রাদেশিক সরকার সংক্রান্ত’।

  • untickedকেন্দ্রীয় সরকার : 
  1. ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলি নিয়ে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
  2. পাঁচ বছর মেয়াদি দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওমা হয়। নিম্নকক্ষের নাম হবে ‘ফেডারেল অ্যাসেম্বলি’ ও উচ্চকক্ষের নাম হবে ‘কাউন্সিল অফ স্টেটস’।
  3. সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
  4. কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও যৌথ – এইরূপে তালিকা নির্দিষ্ট করা হয়।
  5. গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা চূড়ান্ত করা হয়। অর্থাৎ শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করেন।
  • untickedপ্রাদেশিক সরকার :
  1. প্রদেশগুলিতে দ্বৈতশাসনের পরিবর্তে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
  2. প্রদেশগুলির আইন শৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় গর্ভনরের হাতে।
  3. প্রদেশগুলির আইনসভাতেও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
  4. প্রতিটি প্রদেশে গর্ভনর-এর অধীনে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। এবং মন্ত্রীরা তাদের কাজের জন্যে প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন বলে স্থির করা হয়।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আইনে অনেক ত্রুটি বিচ্যুত ছিল। জাতীয় কংগ্রেস এই আইনকে সম্পূর্ণ ‘হতাশাজনক’ বলে অভিহিত করেছিল। এসব সত্ত্বেও এই আইনের কিছু গুরুত্ব ছিল।

  1. এই আইনের দ্বারা ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়।
  3. স্বাধীন ভারতে সংবিধানের কাঠামো এই আইনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
  4. এই আইনের মধ্যে দিয়ে প্রাদেশিক সরকার স্বায়ত্তশাসনের যে অধিকার পেয়েছিল, তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

মূল্যায়ন : এই আইনে দায়িত্বশীল সরকার গঠনের কথা বলা হলেও আদতে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। ভারতবাসীর স্বার্থের দিক দিয়ে এই আইন মোটেও ফলপ্রসূ ছিল না।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত