উপনিবেশবাদ বলতে কী বোঝো? এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নির্ধারণ করো।

(উত্তর)

উপনিবেশিকতাবাদ কী : লাতিন ‘colonia’ শব্দটি থেকে ‘colony’ বা ‘উপনিবেশ’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘উপনিবেশ’ বলতে বোঝায় – 

  • দেশের সীমান্তের বাইরে কোনো রাষ্ট্রের বসতি স্থাপন; অথবা,
  • রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখণ্ড কোনো সেই রাষ্ট্রের কাছে নির্দিষ্টভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে।

বর্তমানে দুই ধরণের উপনিবেশের ধারণা প্রকাশ করা হয় – প্রথম ধরনের উপনিবেশকে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে এবং দ্বিতীয় ধরনের উপনিবেশকে শোষণের জন্য দখল করা হয়।

‘ঔপনিবেশিকতা’-র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। রূপার্ট এমারসন মনে করেন যে, “ঔপনিবেশিকতা হল কোনো বিদেশি জনসাধারণের ওপর দীর্ঘকাল ধরে শাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা।”

সাম্রাজ্যবাদ কী : লাতিন ‘ইম্পেরিয়াম’ শব্দটি থেকে ‘imperialism’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদ’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। প্রথমদিকে এর অর্থ ছিল সামরিক কর্তৃত্ব। পরবর্তীকালে এর অর্থ দাঁড়ায় বৃহৎ রাষ্ট্রের দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ইউরোপে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি নিন্দাসূচক অর্থে ব্যবহার করা শুরু হলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ লেখকগণ নিন্দাসূচক অর্থটি বাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের নতুন অর্থ স্থির করেন।

সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পন্ডিতগণ একমত হতে পারেননি। যেমন, (১) কোনো রাষ্ট্রের নিজস্ব রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে অন্য রাষ্ট্রের ওপর ক্ষমতা বিস্তারের নীতিকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলা যায়। (২) সাম্রাজ্যবাদ হল কোনো একটি দেশের দ্বারা অন্য কোনো দেশের ওপর প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। (৩) কোনো রাষ্ট্র দ্বারা অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল এবং দখল করা ভূখণ্ডে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার নীতিই হল সাম্রাজ্যবাদ।

উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক

  • unticked(ক) সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যগত সম্পর্ক

(ক.১) সাদৃশ্য : উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যেমন

  1. আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ—উভয়ের লক্ষ্য হল শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
  2. সাম্রাজ্যবাদের অংশ : শক্তিশালী কোনাে দেশ বিভিন্ন উপায়ে সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়িত করে অন্য কোনাে দেশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই বিভিন্ন উপায়ের মধ্যে অন্যতম হল উপনিবেশবাদ।
  3. মাত্রা : সাম্রাজ্যবাদী নীতি বিভিন্ন উপায়ে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম একটি উপায় হল ঔপনিবেশিক আগ্রাসন। অর্থাৎ মাত্রার বিচারে সাম্রাজ্যবাদের ব্যপ্তি উপনিবেশবাদের তুলনায় অনেক বেশি।
  4. আগ্রাসন : উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ—উভয়ের লক্ষ্য হল অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালানাে। তবে উপনিবেশবাদী আগ্রাসনের তুলনায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন অনেক বেশি তীব্র। এক কথায়, উপনিবেশবাদকে দুর্বল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বলে অভিহিত করা যায়।

(ক.২) বৈসাদৃশ্য : উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে অনেকগুলি বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়ㅡ

  1. অর্থগত : উপনিবেশবাদ বলতে বাঝায় দেশের সীমান্তের বাইরে কোনাে রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন অথবা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে একটি ভূখণ্ড উক্ত রাষ্ট্রের কাছে নির্দিষ্টভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদ বলতে বােঝায় যখন কোনাে দেশ তার সীমানার বাইরে অন্য দেশের ওপর জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে এবং সেই দেশটিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে।
  2. প্রকৃতিগত : ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে বহু মানুষ এসে বসবাস করে এবং এদের আনুগত্য থাকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রটির প্রতি। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের জনগণ নতুন দখলিকৃত রাষ্ট্রে বসবাস নাও করতে পারে। এখানে নতুন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়া হয় এবং সেখানে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য স্থাপিত হয়।
  3. কৌশলগত : উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক জনগণ নতুন এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করে সেই উপনিবেশবাসীরাই সেখানে নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কায়েম করে। যেমন আমেরিকায় ইংল্যান্ডের উপনিবেশ। অপরদিকে, সাম্রাজ্যবাদের কৌশল হল সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অন্য কোনাে স্থান নিজ দখলে এনে সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
  4. প্রাচীনতার দিক থেকে : মােটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের পর থেকে উপনিবেশবাদের প্রসার শুরু। এই সময় উন্নত নৌশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি বাণিজ্যের প্রসার ঘটানাের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় মন দেয়। তাই উপনিবেশবাদ হল অপেক্ষাকৃত নতুন ভাবধারা। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা অনেক বেশি প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছে।
  • unticked(খ) তাত্ত্বিক সম্পর্ক : এই দুই ধারণার সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদরা তাদের ভাবনার আলোকে ব্যাখ্যা করেন।

(খ.১) হবসনের তত্ত্বের ব্যাখ্যা : হবসন বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদের মূল শিকড় হল উদ্বৃত্ত পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনুসন্ধান। সম্পদের অসম বণ্টনের ফলে যে বাড়তি অতিরিক্ত সঞ্চয় হয়েছিল তা থেকেই এই বাড়তি পুঁজি এসেছিল। 

“Imperialism: A Study” বইতে হবসন বলেন, সাম্রাজ্যবাদের চালিকাশক্তি হল আর্থিক লাভ। পুঁজিবাদীরা মুনাফা ভোগ করে প্রচুর মূলধন জমাতে থাকে। এই মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরও মুনাফা বাড়ানোর জন্য পুঁজিপতিরা তাদের দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। কাঁচামাল ও বাজারের উপর পুঁজিপতিদের একচেটিয়া অধিকার ঘিরে উপনিবেশবাদ গড়ে ওঠে।

(খ.২) লেনিনের তত্ত্ব : “Imperialism : The Highest Stage of Capitalism” গ্রন্থে লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে একচেটিয়া পুঁজিবাদের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন পুঁজিবাদ থেকে সাম্রাজ্যবাদে উত্তরণের পিছনে উৎপাদনের পুঞ্জিভবনের ভূমিকা রয়েছে।

বড় বড় শিল্পের প্রসার, উৎপাদনের বড় অংশের উপর পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ, বাজার দখল, পুঁজিপতিদের জোট তৈরির মাধ্যমে পুঁজিপতিরা উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

লেনিন আরও বলেছেন, সাবেকি পুঁজিবাদের অবাধ প্রতিযোগিতার প্রাধান্যের যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য পণ্য রফতানি। পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে কয়েকটি উন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশের হাতে ব্যাপক পরিমাণ পুঁজি জমতে থাকে। ঐ পুঁজি আর নিজ দেশে বিনিয়োগ সম্ভব নয় বলে তারা এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোর উপর বিনিয়োগের মাধ্যমে উপনিবেশ বিস্তারে সচেষ্ট হয়।

উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ : সাম্রাজ্যবাদের সাফল্য শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাই সাম্রাজ্যবাদ কথাটির সঙ্গে উপনিবেশের ধারণাটি সংযুক্ত হয়ে “ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ” ধারণাটির প্রচলন ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক জনগোষ্ঠী কর্তৃক অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার বিষয়টি জড়িত থাকে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত