(উত্তর)
সূচনা : ইউরোপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর ফলে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের জনগণ সুস্পষ্ট দুটি জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে—
- শাসক জাতি এবং
- শাসিত জাতি।
শাসক জাতি নিজেদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিল। উপনিবেশের বাসিন্দাদের তারা হীন জাতি বলে বিবেচনা করতো এবং তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিত।
জাতিসংক্রান্ত প্রশ্নের ধারণা
- জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার : ইউরোপের ঔপনিবেশিক জাতিগুলি উপনিবেশগুলিতে নিজেদের সীমাহীন জাতিগত গৌরবের কথা প্রচার করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনকালে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল মনে করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনাধীনে অনুন্নত ভারতীয়দের মঙ্গল হচ্ছে। ভারতীয়দের স্বাধীনতাদানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
- শ্ৰেষ্ঠ জাতির প্রাধান্য : সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ জাতিকে শ্রেষ্ঠ এবং উপনিবেশে শাসিত জাতিগুলিকে নিকৃষ্ট বলে মনে করত। পাশাপাশি নিকৃষ্ট জাতির ওপর শ্রেষ্ঠ জাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্মগত অধিকার আছে বলে রাষ্ট্রগুলি ঘোষণা করত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের জাতিগত গর্বের কথা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রচার করতো যে, “ব্রিটিশ জাতির সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্তমিত হয় না।”
- শেতাঙ্গদের উন্নাসিকতা : ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলির বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, কৃষ্ণাঙ্গ জাতির চেয়ে শ্বেতাঙ্গ জাতির মানুষ অনেক বেশি উন্নত। এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষ কখনও শ্বেতাঙ্গদের সমকক্ষ হতে পারে না।
- জাতিগত ব্যবধান : উপনিবেশগুলিতে শাসক জাতি এবং শাসিত জাতির মধ্যে মর্যাদাগত ব্যবধান সহজেই চোখে পড়ে। উপনিবেশে বসবাসকারী জনজাতিগুলি নানা ধরনের ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চম্নার শিকার হলেও ঔপনিবেশিক জাতির মানুষজন বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা লাভ করতো। শাসিত জাতি উচ্চহারে কর প্রদান করে, কায়িক শ্রম দান করে শাসক জাতির জীবনে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে বাধ্য হয়।
- সংস্কৃতিকে অবমাননা করা : শাসক জাতি নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তা উপনিবেশের শাসিত জনসমাজে চাপিয়ে দেয়। ব্রিটিশ সরকার ভারতের সুপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাকে অত্যন্ত নিম্নমানের বলে নিন্দা করে এদেশে নিজেদের ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল।
- বিকৃত জাতীয়তাবাদ : ইউরোপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। এ ধরনের রাষ্ট্রের শাসকরা নিজেদের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠতম বলে মনে করে এশিয়া ও আফ্রিকার অনগ্রসর জাতিগুলিকে পদানত করার উদ্যোগ নেয়।
- সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ : ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি নিজেদের লক্ষ্য ও স্বার্থকে জাতীয় লক্ষ্য ও স্বার্থের সমার্থক বলে প্রচার করে। এরূপ জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত। এরূপ পুঁজিপতিরা পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্ধ দেশপ্রেম ও সংকীর্ণ আত্মগৌরবের কথা প্রচার করে। আর এই আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সেসব দেশ সাম্রাজ্যবাদ প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিল।
উনিশ শতকের বহু আগে থেকেই ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে শাসক-জাতি শাসিত-জাতির বিরুদ্ধে তীব্র জাতিবিদ্বেষ প্রচার করে। উপনিবেশগুলিকে জাতিগত ব্যবধানের সু- ও কু- এই দুই প্রভাবই প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন—
এর প্রভাব
- নঞর্থক প্রভাব বা খারাপ দিক :
- অমানবিকতা–এশিয়া ও আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ শাসিত জাতিগুলি দীর্ঘকাল ধরে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবহেলা ও অমানবিকতার শিকার হয়। বিভিন্ন স্থান ও প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয় জাতির জন্য সংরক্ষিত থাকায় দেশীয় জাতিগুলি সেগুলি ব্যবহারের অধিকার হারায়। কোনো দেশীয় ব্যক্তি কুকুরের সমতুল্য গণ্য হত।
- জাতিগত শোষণ—ঔপনিবেশিক অঞ্চলে শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার জাতিগত ব্যবধান উপনিবেশের মানুষের ওপর তীব্র শোষণ ও অত্যচারের সুত্রপাত ঘটায়। পরাধীন জাতিগুলির ওপর বিপুল পরিমাণ করের বোঝা চাপিয়ে দেয় যাতে তীব্র আর্থিক শোষণ, খাদ্যাভাব প্রভৃতি ঘটনা পরাধীন জাতিগুলিকে সীমাহীন দুরবস্থায় ফেলে দেয়।
- শ্রমিক রপ্তানি–শ্বেতাঙ্গ জাতিগুলি ভারত, চিন-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকদের চুক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় ও উপনিবেশে পাঠাতো। উপনিবেশের খামারগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আসত।
- শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বৈষম্য–উপনিবেশে শাসক শ্বেতাঙ্গ ও শাসিত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তীব্র বৈষম্য ছিল। কৃষ্ণাঙ্গরা কোনোরকম সুযোগ সুবিধা পেত না। পেত না সঠিক বিচার। তারা সব ক্ষেত্রে অবহেলিত হত।
- সদর্থক প্রভাব বা ভালো দিক : জাতিগত-প্রশ্ন প্রসঙ্গে শুধুমাত্র নঞর্থক প্রভাবই ছিল না, এর ভালো দিকও ছিল। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো—
- জ্ঞানের প্রসার
- শিল্পকলার উন্নতি
- বিজ্ঞানের উন্নতি
- পাশ্চাত্য উদার সংস্কৃতির সান্নিধ্য
- নবজাগরণ
উপরের প্রতিটি বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতির উন্নতির জন্য। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে বিজ্ঞান, শিল্পকলায় শাসিত জাতি উন্নতি করতে থাকে। পরবর্তীতে স্বাধীনতালাভের প্রশ্নে এই বিষয়গুলি অনুঘটকের কাজ করেছিল সন্দেহ নেই।