উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব আলোচনা কর। অথবা, সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিন তত্ত্ব আলোচনা কর।

(উত্তর)

সূচনা : আধুনিক বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়েছে, যা ‘ঔপনিবেশিকতাবাদ’ নামে পরিচিত। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদের উদ্যোগ যথেষ্ট বুদ্ধি পেয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাদাতাদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য হলেন জে. এ. হবসন এবং ভি আই লেনিন। এই সম্পর্কে তাঁদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ‘হবসন-লেনিন থিসিস’ (Hobson-Lenin thesis) নামে পরিচিত।

(ক) হবসনের ব্যাখ্যা

জে.এ. হবসন একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। ‘সাম্রাজ্যবাদ-একটি সমীক্ষা’ (Imperialism: A Study) গ্রন্থে তাঁর মূল বক্তব্য সম্বন্ধে জানা যায়। হবসনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি নিম্নরূপ :

[ক.১] উদ্‌বৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি : ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি মালিকদের হাতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর মুলধন সঞ্চিত হয়। ইউরোপের পুঁজিপতিরা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেদের দেশে শিল্পের প্রসার ঘটাত এবং উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য অনুন্নত দেশগুলিতে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত।

[ক.২] পুঁজিপতিদের চাপ : ‘বাড়তি মূলধনের চাপ’ই সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ। পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের উর্দুবৃত্ত মুলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আর মুনাফা অর পরিকল্পনা করে। এজন্য তারা নিজ নিজ দেশের সরকারকে চাপ দিয়ে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে।

[ক.৩] শোষণ : পুঁজিপতি শ্রেণির অন্যতম লক্ষ্য ছিল অধিক মুনাফা ও সম্পদ অর্জন। এই লোভে তারা সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ, উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রির বাজার দখল প্রভৃতির জন্য ইউরোপের বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকায় নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নিজ দেশের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

[ক.৪] ঔপনিবেশিকতা অবসানের উপায় : হবসন বলেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে এর সমাধান হতে পারে। তিনি পুঁজিপতিদের বাড়তি মূলধন দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিতরণ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যে তা ব্যবহারের কথা বলেন। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে তারা কলকারখানায় উৎপাদিত উদ্বৃত্ত শিল্পসামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য আর উপনিবেশ দখলের প্রয়োজন হবে না।

(খ) লেনিনের ব্যাখ্যা

বিখ্যাত রুশ কমিউনিস্ট নেতা ভি আই লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রসারে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘Imperialism : the Highest Stage of Capitalism গ্রন্থে।

[খ.১] পুঁজির উদ্ভব : শিল্পের অগ্রগতির ফলে ইউরোপের দেশগুলির মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সঞ্চিত হয়। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী দেশগুলি ইউরোপের বাইরে নতুন উপনিবেশের প্রসার ঘটিয়ে সেখানে উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

[খ.২] বাজার দখল ও কাঁচামাল সংগ্রহ : লেনিনের মতে,  পুঁজিবাদের জঠরে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। বেশি মুনাফা লাভের আশায় দেশের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পণ্য বিক্রি এবং শিল্পোৎপাদনের জন্য সস্তায় কাচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদী গুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা চালায়।

[খ.৩] প্রতিদ্বন্দ্বিতা : বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখলের উদ্যোগ নিলেও উপনিবেশের সংখ্যা ছিল সীমিত। পরবর্তীকালে উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে কাড়াকাড়ি অর্থাৎ প্রতিযোগিতা হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতার পরিণতি হল যুদ্ধ। লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি হল যুদ্ধের জন্মদাতা।

[খ.৪] শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা : ইউরোপের পুঁজিপতি শ্রেণি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত অঞ্চলগুলিকে বেছে নিয়ে সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সেখানকার নতুন শ্রমিক শ্রেণির ওপর সীমাহীন শোষণ চালায়। এর পুঁজিপতিরা যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করে তার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজ দেশের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে খরচ করে তাদের বশীভূত করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুগত একধরনের অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি তৈরি করে।

(গ) হবসন-লেনিন থিসিসের সমালোচনা

সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে শিল্পোনত ও পুঁজিবাদী দেশগুলি কর্তৃক কাঁচামাল সংগ্রহ, বাজার দখল,  বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনুসন্ধান প্রভৃতি বিষয়গুলির যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হবসন-লেনিন প্রদত্ত ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ দোষমুক্ত ছিল না। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই মতবাদের সমালোচনা করা হয়। যেমন—

  1. উদবৃত্ত পুঁজির সমগ্র অংশই এশিয়া বা আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে লগ্নি করা হয়নি। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তাদের মূলধনের বেশিরভাগটাই রাশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিক বিনিয়োগ করেছিল—যেগুলি তাদের উপনিবেশ ছিল না।
  2. শিল্পবিপ্লব ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে উনিশ শতকে। অথচ তাঁর আগে কেন উপনিবেশের উদ্ভব ঘটল তার কোনো ব্যাখ্যা হবসন বা লেনিনের তত্ত্বে পাওয়া যায় না।
  3. লেনিন মনে করতেন যে, শিল্পোন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অনেকটাই ভালো ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশের কোনো উপনিবেশ ন থাকা সত্ত্বেও এসব দেশের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মনে যথেষ্ট উন্নত ছিল। সেই তুলনায় উপনিবেশিক রাষ্ট্র ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের শ্রমিকদের অবস্থা অনেক খারাপ ছিল।
  4. বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ঔপনিবেশিক শোষণ নয়, সুসম্পর্কের দ্বারাই অধিক পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু হবসন-লেনিনের তত্ত্বে এই সুসম্পর্কের গুরুত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
  5. ডেভিড টমসন সাম্রাজ্যবাদের প্রসাবের লেনিনের তত্ত্বকে মৌলিক ও সম্পূর্ণ বলে মনে করেন না।

(ঘ) গুরুত্ব

সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যায় হবসন ও লেনিনের মতবাদে বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এই মতবাদের গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যা হিসেবে এই তত্ত্ব নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। সাগরপারে বিনিয়োগ যে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল তার প্রমাণ মেলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ থেকে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলি এই সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলে প্রায় ত্রিশ হাজার মিলিয়ন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত