(উত্তর) ‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তগর্ত ‘কর্তার ভূত’ স্বতন্ত্র শ্রেণির গল্প। এটি ‘ব্যঙ্গ-রূপক’ গল্প। ‘গল্পগুচ্ছ’র প্রচলিত গল্প থেকে একেবারেই ভিন্ন ধরনের গল্প হলো ‘কর্তার ভূত’। এর রচনা প্রকরণ একেবারেই স্বতন্ত্র। এর স্বাতন্ত্র্যের কারণ আলোচনায় বলা যায় –
এক। প্রতীকধর্মী গল্প : ‘লিপিকা’র গল্প ভাবমুখ্য ও প্রতীকধর্মী। ‘কর্তার ভূত’ গোত্র বিচারে প্রতীকধর্মী গল্প। এটি ‘ব্যঙ্গ-রূপক’ গল্প। আবার ‘ঘোড়া’ ও ‘তোতাকাহিনী’র মতো এ গল্পটিও রূপকাশ্রিত। কর্তা-সর্বস্ব মানুষের প্রার্থনায় দয়ালু দেবতা জানান, লোকটা ভূত হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাকবে। কেননা, ‘ভূতের তো মৃত্যু নেই।’ সুতরাং, ঘুমন্ত ভূতশাসনতন্ত্রে মানুষ দিব্যি খুশি।
দুই। অদৃষ্ট বিরোধী গল্প : দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে অদৃষ্টের চালে চলতে থাকে। তাদের কোনো চিন্তা নেই। ভূতের বাড়াবাড়িতে তাদের ওঝাকে ডাকতে হয় না। কেননা, ‘ওঝাকে আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে।’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায়নি। ফলে তারা ভূতগ্রস্ত নয়। তারা ভয়ংকর সজাগ আছে। এ গল্প অদৃষ্ট বিরোধী গল্প।
তিন। প্রতিবাদী গল্প : ‘কর্তার ভূত’ প্রতিবাদী গল্প। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি বলেছিলেন- ‘আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহুদিন হ’ল পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছে।’ আমাদের দেশ হাজারতর সংস্কার নিয়ে ক্রমাগত পিছিয়েছে। ফলে কর্তারা কখনও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হারাননি। অর্থাৎ আমরাই কর্তাকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছি।
চার । রূপকের আশ্রয় : ‘কর্তার ভূত’-এ দেবতা, মানুষ আর ভূতের কথা উপস্থাপিত হয়েছে। এই আখ্যানে রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কর্তা নিজে কখনও আমাদের কাছে থাকতে চাননি। সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন- ওরে অবোধ, আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।
পাঁচ ।। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ : কর্তা জানেন, যতক্ষণ ভয় আছে, ততক্ষণ তার অস্তিত্ব আছে। তাই তারা যখন বলে, ‘ভয় করে যে কর্তা’, কর্তা তখন বলেন, ‘সেইখানেই তো ভূত।’ অর্থাৎ এই গল্পটি একটি বিশেষ কালের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যঙ্গ হয়ে উঠেছে।
ছয়। রূপকধর্মী গল্প : বাচ্যার্থ অতিক্রম করে প্রতীয়মান অর্থ এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। তাই এটি রূপকধর্মী গল্প। কেননা, রূপকের সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি এই গল্পের মধ্যে বর্তমান।