গুরুত্বপূর্ণ শব্দের ব্যাখ্যা – সমাজভাষাবিজ্ঞান

রেজিস্টার কী Register

পবিত্র  সরকার বলেছেন, ভাষা একটি বহুতল বাড়ির মতাে। তার সবচেয়ে উপরতলায় থাকে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সম্পন্ন মানুষ, সবচেয়ে নীচে থাকে শিক্ষাহীন বা শিক্ষাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষের দল। এর মাঝখানে আছে আরও অন্যান্যেরা। উপরতলার মানুষের ভাষা পরিশীলিত, নীচের তলার মানুষের ভাষা তা নয়। বক্তা কার সঙ্গে কথা বলছে, কী উপলক্ষ্যে বা কোন্ বিষয়ে কথা বলছে সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সেই অনুযায়ী ভাষার ধরন বদলে যায়। ইংরেজিতে বক্তাকে বলা হয় speaker. শ্রোতা হল receiver এবং উপলক্ষ্য বা প্রতিবেশ হল setting. এই setting অনুযায়ী ভাষার যে বদল, তাকেই ইংরেজ ভাষাবিজ্ঞানীরা register বলেন। অর্থাৎ register হল language change according to use.
একটু সহজ করে বলতে গেলে, বিজ্ঞাপনী প্রচারের ভাষা একটা রেজিস্টার, বক্তৃতার ভাষা একটা রেজিস্টার, আবার মুটেমজুরের ভাষাও একটা রেজিস্টার। নরবার্ট ভিটমার (Norbert Dittmar) এবং ফিশম্যানের অনুসরণে আমরা রেজিস্টারকে বলতে পারি functional variety বা প্রতিবেশিক ভূমিকাগত বৈচিত্র।
কোডবদল (code switching)
কোড-বদল সমাজভাষাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোড হল বিশেষ ভাষাভঙ্গির নাম। কোড সীমিত গােষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষাভঙ্গি। কোনাে ব্যক্তি যে বিশেষ উপভাষার বিশেষ রীতি ব্যবহার করে, সেটি একটি কোড। পরিবেশ বা পরিস্থিতি অনুযায়ী কোডের ব্যবহারকর্তা বা বক্তা যদি তার ভাষা-উপকরণ বা ভাষাভঙ্গি বদল করে তবে তাকে বলা হবে কোড-বদল (code switching)। 
ধরা যাক তিন ব্যক্তির কথােপকথন চলছে। দুজন হিন্দিভাষী এবং তৃতীয়জন হিন্দি বুঝলেও ততটা দক্ষ নয়। প্রথম দুজন নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলতে বলতে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি খেয়াল হওয়ায় ইংরেজি বলতে শুরু করল। এও একরকম কোড-বদল। ঢাকার ভাষায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ যদি কলকাতার মান্য ভাষায় কথা আরম্ভ হয়, সেও কোড-বদল।
স্ল্যাং : অপভাষা, ইতর ভাষা (Slang)
ইংরাজিতে যাকে slang বলা হয় তার দুটি অর্থ। এক, সমাজের বিশেষ কতকগুলি গােষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত অ-মান্য বা অ-শিষ্ট ভাষা। ছুতাের, রাজমিস্ত্রি, ড্রাইভার, মাঝিমাল্লা প্রভৃতি গােষ্ঠীর মধ্যে যে বিশেষ শব্দ ব্যবহৃত হয় সেগুলিও স্ল্যাং। এই স্ল্যাং অ-মান্য বা non-standard বটে, তবে অশ্লীল নয়। এগুলিকে ‘অশিষ্ট পেশাগত বুলি’ বলা যায়। দ্বিতীয়ত, পথে-ঘাটে বা আড্ডায় যে অশিষ্ট ও অশ্লীল ভাষা বা শব্দ ব্যবহৃত হয় তাকেও স্ল্যাং বলা হয়। 
ইংরেজি স্ল্যাংকে বাংলায় কী বলা হবে তা নিয়ে একমত হওয়া কঠিন। সুকুমার সেন বলেছেন ‘ইতর ভাষা’, পবিত্র সরকার বলেছেন ‘অপভাষা’, ‘অপশব্দ’, কুমারেশ ঘােষ বলেছেন ‘জনবুলি’। সুভাষ ভট্টাচার্য বলেছেন ‘অশিষ্ট পেশাগত বুলি’ এবং ‘অশিষ্ট বুলি’।
ইংরেজি ভাষায় স্ল্যাং বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ রচনা করেছেন এরিক পার্টরিজ (Eric Partridge)। তার এ বিষয়ে দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘A Dictionary of Slang and Unconventional English’ এবং Slang Today and Yesterday. 
বাংলায় আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত হয়েছে তিন-চারটি-
ভক্তিপ্রসাদ মল্লিকের অপরাধ জগতের ভাষা’, অপরাধ জগতের শব্দকোষ; 
অভ্র বসুর বাংলা স্ল্যাং-সমীক্ষা ও অভিধান ; 
সত্রাজিৎ গােস্বামীর বাংলা অকথ্যভাষা ও শব্দকোষ মানস রায়চৌধুরী-র ‘বাংলা অশিষ্ট শব্দের অভিধান।
লােকভাষা, লৌকিক ভাষা
লােকভাষা বা গ্রামের মানুষের ভাষাও সমাজভাষাবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়। লােকভাষা কোনাে বিশেষ অঞ্চলের বা জেলার উপভাষা নয়। সাধারণভাবে গ্রামের ভাষাই লােকভাষা। লােকভাষার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। 
প্রথমত, গ্রামের ভাষায় বা লােকভাষায় পরিমার্জনা বা পরিশীলন থাকে না। 
দ্বিতীয়ত, গ্রামের ভাষায় শহরে ভাষার ‘নাগরিকতা থাকে না। 
তৃতীয়ত, গ্রামীণ ভাষার কোনাে নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে শুনি সেখানকার গ্রামের ভাষা, হাওড়ার গ্রামে শুনতে পাই সেখানকার গ্রামের ভাষা। তেমনি আবার বাঁকুড়ার গ্রামে শােনা যাবে বাঁকুড়ার গ্রামীণ ভাষা। ‘নােক’ (লােক), লিচ্চয় (নিশ্চয়), নেকাপড়া (লেখাপড়া), ছেলে (ছিল), য্যাখন (যখন), তেনার বা ত্যানার (তার), পেরথােম (প্রথম), মুনিষ (মজুর) এইসব শব্দ গ্রামীণ ভাষাতেই লভ্য। 
গ্রামের যেসব মানুষ গ্রামেই থাকে, যাদের জীবন আবর্তিত হয় গ্রামকেই ঘিরে, তাদের ভাষার শব্দভাণ্ডার স্বভাবতই কিছুটা সীমিত। আবার যারা বা যাদের পুত্রকন্যারা অপেক্ষাকৃত আলােকপ্রাপ্ত, যাদের সঙ্গে বহির্জগতের সংযােগ ঘটে শিক্ষার জন্যে বা অন্য কারণে, তাদের জীবন কিছুটা মুক্ত এবং স্বভাবতই তাদের ভাষায় এসে যায় কিছুটা পরিশীলন। তবু বলব, গ্রাম্য ভাষা বা গ্রামের ভাষা বলতে সমাজভাষাবিজ্ঞানীরা বােঝেন অমার্জিত, পরিশীলনহীন গ্রামের ভাষা।
দ্বিভাষিকতা (bi-lingualism) ও বহুভাষিকতা (multi-lingualism)
ভাষায় ভাষায় সংযােগ-সংস্পর্শ থেকেই আসে দ্বিভাষিকতা ও বহুভাষিকতা। দ্বিভাষিকতার সহজ অর্থ কোনাে ব্যক্তির দুটি ভাষার ব্যবহার—একটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার মাতৃভাষা, অন্যটি অন্য কোনাে ভাষা। কিন্তু দ্বিভাষিকতার মধ্যে আরও কিছু বিষয় আছে। কোনাে ব্যক্তি তার দ্বিতীয় ভাষাটি হয়তাে বহুকাল ব্যবহারই করেনি। এই ধরনের দ্বিভাষিকদের বলা হয় dormant bilinguals.’ আবার কিছু লােক এমনও আছে যারা দ্বিতীয় ভাষাটি বুঝতে পারে, লিখতে ও পড়তে পারে কিন্তু ভালাে বলতে শেখে না। এরাও দ্বিভাষিক। এমন দ্বিভাষিক নিশ্চয় আছে যারা দ্বিতীয় ভাষাটিও উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছে। যদি বলা যায় একমাত্র তাদেরই দ্বিভাষিক বলা হবে যারা দ্বিতীয় ভাষাটিকেও অত্যন্ত ভালােভাবে আয়ত্ত করেছে—বুঝতে বলতে লিখতে ও পড়তে পারদর্শীতাহলে বলতেই হবে তেমন দ্বিভাষিকের সংখ্যা তত বেশি নয়।
দুটি ভাষা শেখার কারণ সহজ করে বলা যায়, অন্য ভাষার লোকের সঙ্গে আদানপ্রদানের জন্য।
বহুভাষিকতা হলো একজন ব্যাক্তির দুটির বেশি ভাষার ব্যবহার। রাজনৈতিক, ধর্মগত, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত,অর্থনীতিক প্রভৃতি কারণে বহুভাষিকতার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বহুভাষিকতার দুটি দিক রয়েছে। একটি ব্যাক্তির অন্যটি দেশের। ব্যাক্তির ক্ষেত্রে তিনি দুটির বেশি ভাষা ব্যাবহার করতে পারেন। আর দেশের ক্ষেত্রে, যে দেশে বহুরকমের ভাষাভাষীর মানুষের সহাবস্থান ঘটে। যেমন- ভারত।
পিজিন
এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য এক সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালীন সংযােগের ফলে ভাষায় বিকৃতি ঘটে। একে বিকৃতি না বলে কেউ-কেউ পরিবর্তন বলতে চান। এই পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ভাষাকে সুকুমার সেন বলেছেন মিশ্র ভাষা। সেই পরিবর্তনেরই রূপ হল পিজিন ও ক্রিয়ােল। 
পিজিন প্রধানত ইয়রােপীয় জাতিগুলির উপনিবেশ বিস্তারের ফল। তবে অ-ইয়ােরােপীয় পিজিনও আছে, যেমন চিনুক জারগন (Chinook Jargon)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমে আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের ব্যাবসা প্রচেষ্টার ফলে চিনুক জারগনের সৃষ্টি হয়েছে। পিজিনের ব্যবহার খুবই সীমিত বলে পিজিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এই কারণে ভিয়েতনামে ব্যবহৃত ফরাসি-পিজিন যেমন লােপ পেয়েছে, তেমনি লােপ পেয়েছে ভিয়েতনামের পিজিন ইংলিশ। 
কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে পিজিন অবশ্য সহায়ক ভাষার (auxiliary language) মর্যাদা পেয়ে যায়। ডেভিড ক্রিস্টাল এই পিজিনকে capanded pidgin’ বলেছেন। 
পিজিনকে বলা যায় কোনাে ভাষার সরলীকৃত রূপ যা বিদেশি বণিক প্রভৃতি ব্যবহার করে। যে পরিস্থিতিতে দুটি ভাষা-সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ ভাষা (common language) থাকে না, সেই পরিস্থিতিতে পিজিনের সৃষ্টি হয়। পিজিনে শব্দভাণ্ডার সংক্ষিপ্ত বা সীমিত, ব্যাকরণ সরলীকৃত, উচ্চারণেও লক্ষ করা যায় সরলতা। যেখানে ইংরেজরা ব্যাবসার কারণে যায় সেখানে pidgin English-এর উত্তব হয়, যেখানে ফরাসিরা ব্যাবসার কারণে যায়, সেখানে French pidgin-এর উদ্ভব হয়। পিজিন স্বভাবতই অপর ভাষাগােষ্ঠীর পক্ষে বুঝে নেওয়া সহজ হয়। পিক্সিনের ভাষাগত সংগঠন সহজ বলে। তা শেখাও সহজ।
ক্রিয়ােল Creole
পিজিন সবসময়ই সংযােগ-সংস্পর্শের ভাষা, পিজিন সহায়ক বা auxiliary ভাষা। তা কারও মাতৃভাষা নয়। কোনাে পিজিন যদি কোনাে গােষ্ঠীর মাতৃভাষায় পরিণত হয়, তখন তাকে আর পিজিন বলা হয় না, বলা হয় ক্রিয়োল। ক্রিয়োল উদ্ভূত হয় পিজিন থেকেই। কিন্তু আমরা তাে জেনেছি যে, পিজিনের শব্দসম্ভার সীমিত, তার ব্যাকরণগত কাঠামাে অতি-সরল। কাজেই বিশেষ প্রয়ােজনে শব্দভাণ্ডার বেড়ে ওঠে, ব্যাকরণগত কাঠামােতে নতুন প্রকরণ যুক্ত হয় এবং একসময় দেখা যায় যে, সেই পিজিন আর সহায়ক ভাষা শুধু নয়, একটি গােষ্ঠীর প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে। একেই বলে creolization অর্থাৎ পিজিন থেকে ক্রিয়ােলে পরিণতি বা বিকাশ।
খন্ডিত শব্দ (clipped words)
শব্দকে সামনে বা পিছনে ছেঁটে অনেকসময় তৈরি হয় নতুন শব্দ। এ হল এক ধরনের সংক্ষেপণ। এই সংক্ষেপণকে clipping বলা হয়। Clipping বা ছাঁটাইয়ের ফলে যে শব্দটির সৃষ্টি হল তাকে clipped word বা খণ্ডিত শব্দ বলা হয়। Fanatic থেকে fan, omnibus কে bus, refrigerator থেকে fridge, high fidelity থেকে hi-fi এই ছাঁটাইয়ের দৃষ্টান্ত। শিয়ালদা দক্ষিণ শাখার রেলযাত্রীরা বলেন লক্ষ্মী (লক্ষ্মীকান্তপুর), ডায়মন্ড (ডায়মন্ডহারবার)। মনে রাখতে হবে, যেকোনাে সংক্ষেপণই clipping নয়। কপু, (কলকাতা পুলিশ), মাচবা (মান্য চলিত বাংলা) clipping নয়। এগুলি সংক্ষেপণ (মুণ্ডমাল) বটে, কিন্তু ছঁটাই নয়।
সাহায্য – সুভাষ ভট্টাচার্য
error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত