পেশাদারি ইতিহাস বলতে কী বোঝায়? অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য কী? [২০১৭]

পেশাদারি ইতিহাস কী

বর্তমানে ঐতিহাসিকদের অনেকেই ইতিহাসচর্চাকে তাদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং পূর্ণসময়ের জন্য ইতিহাসচর্চায় নিয়োজিত থাকেন। তারা ‘পেশাদার ঐতিহাসিক’ এবং তাদের ইতিহাসচর্চা ‘পেশাদারি ইতিহাসচর্চা’ নামে অভিহিত হয়। এককথায়, ভাবাবেগ, কল্পনা প্রভৃতিকে বর্জন করে কেবলমাত্র যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রামাণ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উনিশ শতকের শেষ দিকে যে ধরনের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে, তাকেই পেশাদারি ইতিহাস বলা হয়।

        মোটামুটিভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ইউরোপে এই ধরনের ইতিহাসচর্চা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ভন র‍্যাঙ্কে ইউরোপে আধুনিক তথ্যনির্ভর পেশাদারি ইতিহাসচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ।

        বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রভৃতির অর্থানুকূল্যে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে নানান ধরনের ঐতিহাসিক গবেষণার কাজ আজ নিরন্তর হয়ে চলেছে এবং উন্মোচিত হচ্ছে ইতিহাসের নব-নব দিগন্ত। এগুলি পেশাদারি ইতিহাসচর্চার অন্যতম উদাহরণ।

পেশাদারি ও অপেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য

প্রাচীনত্ব :

অপেশাদারি ইইতহাসচর্চার ধারা অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের যুগ থেকেই ক্রমে সমগ্র তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে পেশাদারি ইতিহাসর্চার ধারা অপেক্ষাকৃত নবীন। মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউরোপের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পেশাদারি ইতিহাসচর্চার পথ চলা শুরু।

পদ্ধতিগত পার্থক্য :

পেশাদারি ইতিহাস চর্চায় কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার পশ্চাতে কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব সুস্পষ্ট এবং নিত্য-নতুন গবেষণা পদ্ধতি প্রভৃতির ব্যাপক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়।

অন্যদিকে, অপেশাদারি ইতিহাসচর্চায় এগুলি উপেক্ষিত থাকে।

আর্থিক সম্পর্কৰ্গত পার্থক্য :

পেশাদারি ইতিহাসচর্চায় আর্থিক সম্পর্কের বিষয়টি জড়িত থাকে। এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় একজন ঐতিহাসিক পূর্ণ সময়ের জন্য ইতিহাস চর্চায় নিয়োজিত থাকেন এবং ইতিহাসচর্চাকে তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সরকারী প্রকল্প থেকে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তি পেশাদারি ইতিহাসর্চার একটি অন্যতম দিক। কিন্তু অপেশাদারি ইতিহাসচর্চা মূলত বিনোদন মূলক এবং অবসর বিনোদনের অঙ্গ। এক্ষেত্রে ইতিহাসচর্চা ঐতিহাসিকের জীবন-জীবিকায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।

ব্যাপ্তিগত পার্থক্য :

পেশাদারি ইতিহাসচর্চার ব্যাপ্তি বা পরিসর অপেক্ষাকৃত বৃহৎ এবং তা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও পরিব্যাপ্ত। অন্যদিকে, অপেশাদারি ইতিহাসর্চা মূলত ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে হয়ে থাকে এবং স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাসের বিভিন্ন দিক অপেশাদারি ইতিহাসচর্চায় প্রতিভাত হয়।

নিরপেক্ষতার পার্থক্য :

পেশাদারি ইতিহাসচর্চা সাধারণত পক্ষপাতশূন্য হয়ে থাকে। এই ইতিহাসচর্চায় একজন ঐতিহাসিক স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তির দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা দেন। ফলে ইতিহাস বিকৃতির সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু, অপেশাদারি ইতিহাসচর্চায় এই সম্ভাবনা প্রবল। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ব্যক্তিগত অভিরুচি বিশেভাবে কাজ করে।

মূল্যায়ন :

সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায়, ঐতিহাসিক মানব সমাজের বাইরের কোনো জীব নন। স্বভাবতই ব্যক্তি-ঐতিহাসিকের সংস্কার, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, ধর্ম বিশ্বাস তাঁর লেখনীকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। ফলে পেশাদারি ইতিহাসচর্চাতেও ঘটে বড়সড় ছন্দপতন। তাই ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠীকে উদ্ধৃত করেই আলোচনার ইতি টানা যায়—“ইতিহাস জানার আগে ঐতিহাসিককে জানতে হবে।”

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত