অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে মিথ এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা আলোচনা করো।

(a) মিথ কী :

জনশ্রুতির দুটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল—মিথ বা পৌরাণিক কাহিনি এবং লিজেন্ড বা কিংবদন্তী। গ্রিক শব্দ ‘Muthos’ থেকে ইংরেজি ‘Myth’ শব্দটির উদ্ভব, যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘পৌরাণিক কাহিনি’ বা ‘উপকথা’। সাধারণভাবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন কাহিনি বা ঘটনার বিবরণ যে প্রায়-ঐতিহাসিক উপাদানে তুলে ধরা হয়, তাকে পৌরাণিক কাহিনি বলে। এগুলি সাহিত্যের সর্বপ্রথম রূপ।

নানা কাল্পনিক ঘটনা থেকেই পৌরাণিক কাহিনির উৎপত্তি। এগুলি মুলত স্মৃতির পথ বেয়ে বংশ পরম্পরায় পরবর্তী যুগে পৌঁছোয়। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই পৌরাণিক কাহিনির অস্তিত্ব রয়েছে। দেবী দুর্গার জন্ম ও অসুর বধের কাহিনি বা চাঁদ সদাগর ও বেহুলা লখীন্দরের কাহিনি জনপ্রিয় ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনির উদাহরণ। ঐতিহাসিক জে. এফ. বিয়ারলেইন তাঁর Parallel Myths গ্রন্থে লিখেছেন, এগুলি হল ‘আমাদের অবচেতন মনের কাহিনি বিশেষ, যা সম্ভবত আমাদের জিনের মধ্যেই লিপিবদ্ধ থাকে।

(b)    অতীতের পুনর্গঠনে মিথের ভূমিকা

মিথ বা পৌরাণিক কাহিনি অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে, যেমন—

(b.1) ঐতিহাসিক সত্যতা :

মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি হল ‘গল্পের ছলে সত্য ঘটনার প্রকাশ’। অতীতের বিভিন্ন রাজবংশের বংশতালিকা বা রাজবংশগুলির ক্রমিক তালিকা, রাজাদের কার্যকলাপ, প্রাচীন নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, প্রাচীন শহর-নগর-তীর্থস্থান প্রভৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে আহরণ করা সম্ভব।

(b.2) সময়কাল নির্ণয় :

বিভিন্ন মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাই করে ইতিহাসের সাল-তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ফলে অতীতের ধারাবাহিক ছবি মিথের মাধ্যমে মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে পারে।

(c) স্মৃতিকথা কী :

যে আখ্যানধর্মী সাহিত্যে লেখক তাঁর অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণা করে থাকেন, তাই-ই হল স্মৃতিকথা। স্মৃতিকথার উপর নির্ভর করেই মানুষ তাঁর ফেলে আসা অতীতের দিকে ফিরে তাকায়। সাধারণভাবে বলা যায়, ইতিহাসের যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু হয় স্মৃতিকথার পথ চলা।

দক্ষিণারঞ্জন বসুর ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’, মনিকুন্তলা সেনের ‘সেদিনের কথা’, সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরি’, মান্না দে-র ‘জীবনের জলসাঘরে’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথার উদাহরণ।

(d)    অতীতের পুনর্গঠনে স্মৃতিকথার ভূমিকা

(d.1) প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ :

স্মৃতিকথা অথবা আত্মজীবনী একজন ব্যক্তি ও তাঁর সময়ের কথা তুলে ধরে। এই থেকে নানান তথ্য, সমকালীন ঘটনা ও দৃষ্টিভঙ্গির হদিশ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশভাগের অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা, যন্ত্রণা, ছন্নছাড়া জীবন, বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয়গ্রহণ ও পুনর্বাসন প্রভৃতি সমকালীন অনেক বিষয় সমসাময়িক মানুষের আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় স্থান পেয়েছে।

(d.2) ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র প্রদান :

স্মৃতিকথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যবান তথ্যসূত্র হিসেবে কাজকরে। যেমন—১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকবাহিনী পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের উপর যে অত্যাচার ও হত্যালীলা চালায়, তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হল সমকালীন স্মৃতিকথাগুলি।

(d.3) গুণীজনদের বিবরণ :

অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্মৃতিকথাগুলি কোনো না কোনো গুণী ব্যক্তির রচনা। ফলে, এগুলিতে অবান্তর বা অতিরঞ্জিত ঘটনাবলির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম।

(e) মূল্যায়ন :

পরিশেষে বলা যায়, মানব সমাজের ফেলে আসা অতীতের পুনর্গঠনে মিথ বা স্মৃতিকথাগুলির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকলেও এগুলি থেকে ইতিহাস রচনা বহুক্ষেত্রেই ঝুঁকি সাপেক্ষ। এগুলিতে সত্য-মিথ্যা-সম্ভাবনা, ব্যক্তিগত অভিরুচি, অতিরঞ্জন প্রভৃতি মিলে-মিশে থাকায় ইতিহাস বিকৃতির সম্ভাবনা প্রবল। তাই এগুলি থেকে ইতিহাস লিখনের পূর্বে অন্যান্য যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত