মিথ (পৌরাণিক কাহিনি/উপকথা) ও লিজেন্ড (কিংবদন্তী) বলতে কী বোঝো? অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে এরা কীভাবে রূপদান করে? [২০১৫]

মিথ কী :

জনশ্রুতির দুটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল—মিথ বা পৌরাণিক কাহিনি এবং লিজেন্ড বা কিংবদন্তী। গ্রিক শব্দ ‘Muthos’ থেকে ইংরেজি ‘Myth’ শব্দটির উদ্ভব, যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘পৌরাণিক কাহিনি’ বা ‘উপকথা’। সাধারণভাবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন কাহিনি বা ঘটনার বিবরণ যে প্রায়-ঐতিহাসিক উপাদানে তুলে ধরা হয়, তাকে পৌরাণিক কাহিনি বলে। এগুলি সাহিত্যের সর্বপ্রথম রূপ।

নানা কাল্পনিক ঘটনা থেকেই পৌরাণিক কাহিনির উৎপত্তি। এগুলি মুলত স্মৃতির পথ বেয়ে বংশ পরম্পরায় পরবর্তী যুগে পৌঁছোয়। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই পৌরাণিক কাহিনির অস্তিত্ব রয়েছে। দেবী দুর্গার জন্ম ও অসুর বধের কাহিনি বা চাঁদ সদাগর ও বেহুলা লখীন্দরের কাহিনি জনপ্রিয় ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনির উদাহরণ। ঐতিহাসিক জে. এফ. বিয়ারলেইন তাঁর Parallel Myths গ্রন্থে লিখেছেন, এগুলি হল ‘আমাদের অবচেতন মনের কাহিনি বিশেষ, যা সম্ভবত আমাদের জিনের মধ্যেই লিপিবদ্ধ থাকে।

লিজেন্ড কী :

ল্যাটিন শব্দ ‘Legenda’ থেকে ইংরেজি ‘Legend’ শব্দটির উদ্ভব, যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘কিংবদন্তী’ বা ‘বীরগাথা’। সাধারণভাবে বলা যায়, খানিক ইতিহাস ও বাকিটা কল্পনার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা বিশেষ লোককাহিনি হল কিংবদন্তী। কোনো এক অসামান্য ব্যক্তি-চরিত্র ও তাঁর অলৌকিক কার্যকলাপই হল কিংবদন্তী বিষয়বস্তু। এগুলি মূলত মনুষ্য-কেন্দ্রিক ঘটনা।

অতীতের পুনর্গঠনে মিথের ভূমিকা

মিথ বা পৌরাণিক কাহিনি অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে, যেমন—

ঐতিহাসিক সত্যতা : মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি হল ‘গল্পের ছলে সত্য ঘটনার প্রকাশ’। অতীতের বিভিন্ন রাজবংশের বংশতালিকা বা রাজবংশগুলির ক্রমিক তালিকা, রাজাদের কার্যকলাপ, প্রাচীন নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, প্রাচীন শহর-নগর-তীর্থস্থান প্রভৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে আহরণ করা সম্ভব।

সময়কাল নির্ণয় : বিভিন্ন মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাই করে ইতিহাসের সাল-তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ফলে অতীতের ধারাবাহিক ছবি মিথের মাধ্যমে মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে পারে।

অতীতের পুনর্গঠনে লিজেন্ডে-র ভূমিকা

প্রচলিত কিংবদন্তীগুলি অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে।

ঐতিহাসিক তথ্যের সূত্র : প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা তথা চরিত্রের সত্যতা নিরূপণ করা যেতে পারে।

ঐতিহাসিক ভিত্তি : কিংবদন্তীর কাহিনি রূপকথার কাহিনির মতো সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়, বহুক্ষেত্রেই প্রচলিত কিংবদন্তীগুলির একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে।

অনুপ্রেরণা লাভ : কিংবদন্তীর ঘটনা ও চরিত্রাবলির বীরত্ব, নৈতিকতা ও জীবনদর্শন মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র প্রমুখ কিংবদন্তী চরিত্রের সাহসিকতা, বীরত্ব ও মূল্যবোধ আজও ভারতীয়দের কাছে অনুকরণীয়। আবার হারকিউলিসের সাহস ও বীরত্ব আজও গ্রিকদের অনুপ্রাণিত করে।

মূল্যায়ন : মানব সমাজের ফেলে আসা অতীতের পুনর্গঠনে মিথ ও লিজেন্ড নানাভাবে সাহায্য করলেও এগুলি থেকে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিককে হতে হবে সতর্ক এবং সাবধানী। এগুলিতে কল্পনা এবং অবাস্তবতা মিশে থেকে তথ্যের ঐতিহাসিকতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে। তাই যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই এগুলিকে গ্রহণ করতে হবে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত