[৪+৪] সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ লেখ। সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।

[উ]

ভূমিকা—অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতক জুড়ে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলীন্যপ্রথা, জাতিভেদপ্রথা অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথা সমাজের অগ্রগতির পথে বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঊনবিংশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের প্রথম কয়েকটি দশক পর্যন্ত বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্যোগে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রসার ঘটে।

[ক] ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা

ব্রিটিশ সরকার সংস্কার আন্দোলনের চাপে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে ও আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। যেমন—

(ক.১) শিশুহত্যা রদ : ভারতীয় হিন্দুসমাজে দীর্ঘকাল ধরে গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শিশুকন্যা হত্যার মতো কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। ১৭৯৫ এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে সরকার আইন পাস করে এই দু-ধরনের শিশুহত্যা নিষিদ্ধ করেন।

(ক.২) সতীদাহপ্রথা রদ : ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্যও সরকার সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর XVII নং রেগুলেশন আইন দ্বারা বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই অমানবিক প্রথা রদ করেন। এই আইনে সতীদাহ প্রথা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষিত হয়।

(ক.৩) বিধবাবিবাহ আইন : পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দুসমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন। বড়োলাট লর্ড ডালহৌসির আমলে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবাবিবাহ’ আইনসম্মত বলে ঘোষণা করা হয়।

(ক.৪) নরবলিপ্রথা রদ : বড়োলার্ট লর্ড হার্ডিও উড়িষ্যার খোন্দ উপজাতিদের মধ্যে নরবলিপ্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ উদ্যোগে এই অমানবিক প্রথার অবসান ঘটানো সম্ভব হয়।

(ক.৫) দাসত্বপ্রথা রদ : প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় সমাজে দাসত্বপ্রথার প্রচলন ছিল। লর্ড অকল্যান্ড ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের মাধ্যমে ভারতে এই প্রথার অবসান ঘটান।

[খ] সমাজসংস্কারের ফলশ্রুতি

সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলাফলগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল—

(খ.১) কুসংস্কার প্রবণতা হ্রাস : সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতীয় সমাজ থেকে বহু কুসংস্কার দূর হতে শুরু করে। বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস প্রভৃতির বাধন শিথিল হতে শুরু করে।

(খ.২) পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার : বিভিন্ন সমাজসংস্কারক আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নিলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গতি আসে। সরকারও পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। ক্রমে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, যুক্তিবাদ,  মানবতাবাদ, বিজ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে।

(খ.৩) জাতীয়তাবাদের বিকাশ : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমে ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে এবং তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে শুরু করে।

(খ.৪) নারী প্রগতি : সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতে নির্যাতিত নারীসমাজ অনেকটা মুক্তি পায়। অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কন্যা সন্তান হত্যা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহপ্রথা, পর্দাপ্রথা, পণপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংস্কারমূলক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত