[উ] ভারতীয় মুসলিমরা প্রথম থেকেই এদেশে ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি। ফলে তাঁরা শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। মুসলিমরা একদিকে যেমন সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তেমনি নিজেদের সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এভাবে শিক্ষাদীক্ষা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সরকারি চাকরি প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে মুসলিম সমাজ ক্রমে হতাশার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
(ক) সৈয়দ আহমদ খানের আবির্ভাব ও ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন
পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের ‘ত্রাণকর্তা’ হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের (১৮১৭-১৮৯৮) আবির্ভাব ঘটে। তিনি দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষা ও ইসলামীয় শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। মহাবিদ্রোহের সময় তিনি বিজনোর-এর ‘সদর আমিন’ পদে নিযুক্ত ছিলেন।
সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজ ও ইংরেজ সরকার—উভয় পক্ষকে বুঝিয়ে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তিনি ইংরেজদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, মুসলিমরা ইংরেজ-বিরোধী নয়। অন্যদিকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকারও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে।
(খ) সৈয়দ আহমদ খান ও আলিগড় আন্দোলন
মুসলিম সমাজে আধুনিকতার প্রসারে স্যার সৈয়াদ আহমেদ খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজি শিক্ষা, সমাজসংস্কার ও আধুনিকতার প্রসার ছাড়া মুসলিম সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি মুসলিম সমাজকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, পবিত্র কোরানই সকল জ্ঞানের আধার এবং মুসলিমদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ। তিনি মুসলিম সমাজে নারীস্বাধীনতা ও নারীশিক্ষার বিস্তারের পক্ষে এবং পর্দাপ্রথা, বহুবিবাহ ও পত্নীকে তালাক দেওয়ার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেন।
(খ.১) শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ—মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদ খান বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে গাজিপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘সায়েন্টিফিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সৈয়দ আহমদ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে ‘অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটি বর্তমানে ‘আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে পরিচিত।
(খ.২) আলিগড় আন্দোলন—আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করেই মুসলিম সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিবর্তিত হয়। মুসলিম সমাজের এই জাগরণ ‘আলিগড় আন্দোলন’ নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, হিন্দু-বিদ্বেষ, বাঙালি-বিদ্বেষ, কংগ্রেস-বিদ্বেষ এবং ইংরেজ তোষণই ছিল আলিগড় আন্দোলনের প্রধান মূলধন। আলিগড় আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে ছিলেন চিরাগ আলি, আলতাফ হোসেন আলি, নাজির আহম্মদ, খুদা বক্স প্রমুখ।
(খ.৩) হিন্দু-মুসলিম বিরোধিতার আদর্শ—সৈয়দ আহমদ খান প্রচার করতে শুরু করেন যে, হিন্দু ও মুসলিম কেবল দুটি পৃথক জাতিই নয়–যুদ্ধরত দুটি পৃথক জাতি। তাঁর মতে, কংগ্রেস হল ‘বাঙালি বাবুদের’ স্বার্থে পরিচালিত একটি ‘হিন্দু সংগঠন’ এবং কংগ্রেসের আন্দোলন হল ‘অস্ত্রবিহীন গৃহযুদ্ধ’। সৈয়দ আহমদের এই আদর্শেই আলিগড় আন্দোলন পরিচালিত হয়।
(খ.৪) থিয়োডোর বেক-এর ভূমিকা—আলিগড় আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রসারে আলিগড় কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আলিগড় কলেজ হিন্দু-বিরোধী, বাঙালি-বিরোধী ও কংগ্রেস-বিরোধী রাজনৈতিক প্রচারকার্যের মূলকেন্দ্রে পরিণত হয়। মুসলিম স্বার্থরক্ষা ও ব্রিটিশ শাসনকে সুদৃঢ় করাই ছিল মূল লক্ষ্য। সৈয়দ আহমদের পর এই আদর্শেই আলিগড় আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে।
(খ.৫) আলিগড় আন্দোলনের নীতি—আলিগড় আন্দোলন মূলত চারটি মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হত—[] হিন্দু-মুসলিম পরস্পরবিরোধী স্বার্থযুক্ত দুটি যুদ্ধরত জাতি, [] প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ সরকারি পদে নিয়োগ মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী, [] ব্রিটিশ সরকারের হাতে মুসলিমদের স্বার্থ সুরক্ষিত এবং [] তারা কেবল সাংস্কৃতিক উন্নয়নেই নিজেদের নিয়োজিত রাখবে এবং কেবলমাত্র হিন্দু রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীদের ক্ষমতা খর্ব করতেই তারা রাজনীতিতে অংশ নেবে।
(খ.৬) সীমাবদ্ধতা—সৈয়দ আহমদের সংস্কার প্রচেষ্টা বিশেষ সফলতা লাভ করেনি। গোঁড়া মৌলবি ও মোল্লা শ্রেণি সৈয়দ আহমদের সংস্কার-প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছিল। তাছাড়া আলিগড় আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিছু জমিদার, উচ্চবিত্ত মানুষ ও চাকরিজীবীর স্বার্থই ছিল এই আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি। মূল্যায়ন = সৈয়দ আহমদ খান দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ প্রচারের জন্য ঐতিহাসিকদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন। কেঊ কেঊ বলেছেন, আলিগড় আন্দোলনের প্রভাবেই ১৯০৬-এ ‘মুসলিম লিগ’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি ওঠে। তবুও সৈয়দ আহমেদ খানের কৃতিত্বকে অস্বীকার যায় না। রমেশচন্দ্র মজুমদার আলিগড় আন্দোলনকে মুসলিম সমাজের নবজাগরণ বলে উল্লেখ করেছেন।