প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বিজ্ঞানচর্চার পরিচয় দাও।

ভূমিকা–প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪) ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক। পূর্বতন যশোর জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বনেদি পরিবারের সন্তান হওয়ায় শিশু বয়স থেকেই সমস্ত বিষয়ে তিনি ছিলেন তুখোড়।

শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন—প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করার আগেই গিলক্রাইস্ট বৃত্তি হয়ে ১৮৮২ সালে বিলেতে যান। সেখানে বি এসসি পাস করেন এবং ১৮৮৭ সালে রসায়নশাস্ত্রে মৌলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ গবেষণার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোপ পুরস্কার পান।

১৮৮৮ সালে দেশে ফেরেন। পরের বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর শিক্ষক ও গবেষকজীবন। এরপর ১৯৩৭ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি যখন পরিপূর্ণ অবসর নিতে চাইলেন, তখন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে এমিরিটাস অধ্যাপক হিসাবে রসায়নের গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখেন।

বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়ে তিনি কলেজেরই দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি ঘরে থাকতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই ঘরে কাটিয়েছেন। কলেজে সব সময় ৮-১০ জন ছাত্র গবেষণার কাজে তাঁর কাছে থাকতেন।

কৃতিত্ব—প্রফুল্লচন্দের প্রথম মৌলিক গবেষণা খাবারে ভেজাল নির্ণয়ের রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন-সংক্রান্ত। তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার মারকিউরাস নাইট্রাইট। এ ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতু আবিষ্কার করে তিনি রসায়ন জগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। গবাদি পশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক অ্যাসিড যোগ করে তিনি সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন।

শুধু গবেষণা নয়, গবেষণার ফল কাজে লাগানোর জন্য তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’।

ভারতে বিধিবদ্ধ সমবায় আইন চালু হলে ১৯০৬ সালে তিনি রাঢুলি এবং এর আশপাশের গ্রামের মানুষকে জড়ো করে ৪১টি কৃষি ঋণদান সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। চিরকুমার প্রফুল্লচন্দ্রের জীবন ছিল অনাড়ম্বর। ছাত্রদের সঙ্গে ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক।          

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রেরণায় ও অর্থসাহায্যে ‘ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা এবং শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে তিনি অকৃপণভাবে সাহায্য করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা প্রবর্তনের একজন প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।

তাঁর আত্মচরিত ‘Life and Experiences of a Bengali Chemist’ ছাড়াও তিনি ‘বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’, ‘অন্নসমস্যায় বাঙ্গালীর পরাজয় ও তাহার প্রতিকার, “History of Hindu Chemistry’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত