একাদশ শ্রেণির কবিতা সংকলনের মধ্যে মধুসূদন দত্তের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকবিতা একটি অন্যতম কবিতা। পরীক্ষা উপযোগী রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর এখানে আলোচিত হলো।
প্রশ্ন–১ ‘হায় পাগলিনী জনা’ – পাঠ্যকবিতা অনুসরণে পাগলিনী জনার চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
অথবা ‘ক্ষত্র–কুলবালা আমি; ক্ষত্র কুল বধূ – বক্তার এমন মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা কর।
প্রাক্কথন—কবি মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকবিতার জনা হলো রাজা নীলধ্বজের পত্নী, যিনি যথার্থই বীরাঙ্গনা চরিত্র।তার মধ্যে মাতৃত্ববোধ প্রবল।তিনি ক্ষত্রিয় কুলবালা এবং ক্ষত্রিয় কুলবধূ। এইপত্রকবিতায় জনা চরিত্রের যেস্বরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে, তাকতগুলি সূত্রে উপস্থাপন করা যায়।
[ক] জননীরূপে জনা—জনার একমাত্র অবলম্বন তার পুত্র প্রবীর। জননীর কাছে সবথেকে আকাঙ্ক্ষার জায়গা হলো তার সন্তান। সেই সন্তানকে হারিয়ে জননী জনা নিঃস্ব হয়েছেন। তাই সন্তানহারা মায়ের আক্ষেপ—
“হাপুত্র! শোধিলি কি রেতুই এই রূপে
মাতৃধার?”
[খ] বীরাঙ্গনা রূপে জনা—পুত্রের মৃত্যুকে জনা গর্ব হিসেবেই দেখেছেন। তিনি বীরাঙ্গনা। স্বামীকে তাই উদ্দীপ্ত করেছেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায়। তিনি রণসাজে সজ্জিত হওয়ার জন্যে প্রার্থনা করেছেন নীলধ্বজকে। জানতে চেয়েছেন—
“সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে–
প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে”
[গ] প্রতিহিংসাপরায়ণা—পুত্রশোকের আকুলতা জনাকে উন্মাদিনী করে দিয়েছে।তিনি শোকের আগুন ‘ফাল্গুনীর লোহে’ নির্বাপিত করতে চেয়েছেন। পুত্রঘাতীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্বামীর কাছে প্রার্থনা করেছেন—“খণ্ডমুণ্ড তার আন শূলদণ্ড–শিরে”।
[ঘ] প্রতিবাদিনী জনা—আলোচ্য পত্রকবিতায় কবি জনাকে প্রতিবাদী হিসাবে অঙ্কন করেছেন। মহান চরিত্র যথা ব্যাস, অর্জুন, কৃষ্ণ প্রত্যেকেই অন্যায় করছেন, তা জানাতে ভোলেনি জনা।কুন্তী ও দ্রৌপদীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করতে জনা দ্বিধাবোধ করেননি।
[ঙ] অসহায়া জনা—পাঠ্য কবিতায় জনা চরিত্রটিকে অসহায় রূপে চিহ্নিত করা যায়।শোকাকূলা জনা পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারেননি। স্বামী নীলধ্বজকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সদর্থে সে অসহায়া। তাই অভিমানিনী জনা জাহ্নবীর জলে আত্মবিসর্জন দিতে চেয়েছেন—“ছাড়িব এপোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে”!
মূল্যায়ণ—‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় জনা মূল চরিত্র। সমগ্র কবিতার ছত্রে ছত্রে জনার বীরাঙ্গনার রূপ ফুটে ওঠে। জনার কটাক্ষ, প্রতিবাদ, প্রতিহিংসা, অভিমান সমস্ত কিছুই তাকে বীর নারীতে পরিণত করেছে।যদিও শেষাংশে নিজেক ব্যর্থ মনে করে আত্মবিসর্জনের পথবেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রশ্ন–২ ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় জনা অর্জুনের কাপুরুষতার কী কী দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন?
সূচনা—মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্র–কবিতায় অর্জুন চরিত্রটি প্রত্যক্ষভাবে নেই।মাহেশ্বরপুরীর রানি জনার দৃষ্টিতে তৃতীয় পান্ডব অর্থাৎ অর্জুনকে পাঠক প্রত্যক্ষ করেন।
অর্জুনের কাপুরুষতা
রাজমাতা জনা চেয়েছিলেন, রাজা নীলধ্বজ নিশ্চয়ই পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, নীলধ্বজ অর্জুনের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করেছেন। তাই জনা ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত।
জনা স্বামীকে বোঝাতে চাইছেন যে, অর্জুনের একক কৃতিত্ব বলে কিছু নেই; সবই ছলাকলা ও কৃষ্ণের সহায়তা।তাই জনা কখনো ‘মহাপাপী’ কখনো ‘নরাধম’ আবার কখনো ‘বর্বর’ বলে তিরস্কার করেছেন।
অর্জুন ক্ষত্রিয় বীর, মহাযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। অথচ প্রকৃত যোদ্ধার রণকৌশল তিনি অনুসরণ করেননি। অর্জুনের এইকাপুরুষতার একাধিক দৃষ্টান্ত আমরা জনার কাছ থেকে পাই—
১) স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণা করেছিলেন।
২) নিজের একক ক্ষমতায় অর্জুন খান্ডব বন দহন করতে সমর্থ হননি। একাজে কৃষ্ণ তাকে সহায়তা করেছিলেন।
৩) শিখণ্ডীর সাহায্য ছাড়া তিনি কিছুতেই পিতামহ ভীষ্মকে বধ করতে পারতেন না।
৪) গুরু দ্রোণাচার্যকে বধ করেছেন কৃষ্ণের প্রত্যক্ষ সহায়তায়।
৫) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। সেই রথচক্র উদ্ধারকালে নিরস্ত্র কর্ণকে হত্যা করেন অর্জুন।
এইপ্রসঙ্গে অর্জুনের অবৈধ জন্ম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জনা।এইভাবে একাধিক প্রসঙ্গ উত্থাপন করে স্বামী নীলধ্বজকেও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন–৩ ‘মহারথী প্রথা কি হে এই, মহারথী?’ – কার প্রতি কে এই উক্তি করেছেন? মহারথী প্রথা কী? কে কিভাবে তা লঙ্ঘন করেছেন?
কার প্রতি উক্তি—প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।
এখানে জনা তার স্বামী নীলধ্বজের প্রতি এই উক্তি করেছেন।
মহারথী প্রথা—ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের রীতি বা আদর্শ হলো নিরস্ত্র প্রতিপক্ষ যোদ্ধাকে যুদ্ধে আহ্বান না করা, তাকে আক্রমণ না করা, অসমবয়সী অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে অস্ত্রাঘাত না করা, তাকে যুদ্ধে হত্যা না করা। ক্ষত্রিয় মহাবীরেরা এই মহান আদর্শ অনুসরণ করেন। এই হলো মহারথী প্রথা। রাজরানি জনা এই মহারথী প্রথগার কথাই বলেছেন।
মহারথী প্রথা লঙ্ঘন—জনা অভিযোগ করেছেন, অর্জুন মহারথী প্রথা না মেনেই তার পুত্র প্রবীরকে হত্যা করেছে।জনা অভিযোগের সুরে বলেছেন ঠিক এইভাবেই অর্জুন ভীষ্ম–বধ করেছিলেন। অন্যায়ভাবে কর্ণ–বধ করেছিলেন। যুদ্ধের নিয়ম না মেনেই আচার্য দ্রোণকে হত্যা করেছিলেন।
সুতারাং জনার কথা অনুযায়ী অর্জুন—
ক) মহাপাপী
খ) নরাধম
গ) বর্বর
অর্জুন সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেননি জনা।অর্জুন ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রবীরকে হত্যা করে মহারথী প্রথার আদর্শ লঙ্ঘন করেছেন।
প্রশ্ন–৪ ‘কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা’ – বক্তার এই আক্ষেপ কেন? এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
আক্ষেপের কারণ—অংশটি মধুসূদন দত্ত প্রণীত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ (‘বীরাঙ্গনা’) পত্র কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।
রাজমাতা জনা বিশ্বাস করতেন, তার স্বামী নীলধ্বজ নিঃসন্দেহে পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু তার সেই বিশ্বাস তাসের ঘরের ভেঙে যায়। সেইজন্য জনা আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
জনা দেখেছেন—
১) স্বামী নীলধ্বজ পার্থের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় প্রস্তুতি নেননি।
২) স্বামী পুত্র–হন্তার সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
৩) অর্জুনের জন্যই রাজপুরী সজ্জিত হয়েছে, নাচ–গানের আয়োজন করা হয়েছে। রাজমাতা জনা স্বামীকে জানাচ্ছেন, তিনি যেন ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করেন। অর্জুনকে চণ্ডালের সঙ্গে তুলনা করে জানান—“চণ্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে”।
এইসব সত্ত্বেও জনা স্বামীকে নিন্দা করতে পারেননি। কেননা স্বামী তার কাছে গুরুজন।তাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এবং ব্যর্থ হয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
বক্তার প্রতিক্রিয়া—বক্তা জনা কখনোই নিজে পার্থের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে পারেন না। তাই তার মর্মপীড়া মৃত্যুর মধ্যেই সমাপ্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন—
“ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে”।
প্রশ্ন–৫ ‘বীরাঙ্গনা‘ শব্দের অর্থ কী? জনা কি প্রকৃতই বীরাঙ্গনা—যুক্তিসহ লেখো।
১) বীরাঙ্গনা—‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ক্ষত্রিয় তেজে উদীপ্ত রমণী।
২) জনা কী প্রকৃতই বীরাঙ্গনা—কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা‘ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতার মধ্যে জনার তেজস্বিনী, বীরাঙ্গনা মূর্তিটি অঙ্কিত হয়েছে। জনার নামে নামাঙ্কিত এই পত্রিকাটিতে জনার তেজ, ক্ষোভ এবং অসহায় হৃদয়ের কথা ব্যক্ত হয়েছে। এখানে বীরপুত্র প্রবীরের মৃত্যুকে জনা গর্বের সঙ্গে দেখেছেন। স্বামীকে তিনি বারবার উদ্দীপ্ত করেছেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রায়। তিনি রণসাজে সজ্জিত হওয়ার আহ্বান করেছেন নীলধ্বজকে।
নগরীতে উৎসবের আয়োজনের কারণ জানতে চেয়েছেন। প্রথমেই তিনি স্বামীকে সরাসরি অভিযোগ করেননি। তার মধ্যে কুণ্ঠা ছিল, সেই কুণ্ঠা থেকে জানতে চেয়েছেন—
“সাজিছ কি নররাজ যুঝিতে সদলে—
প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে,
নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্গুনির লোহে?”
বীরপুত্র যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। তার মৃত্যুর কারণ অর্জুন। সুতরাং জনা চেয়েছেন নীলধ্বজ যেন অর্জুনকে যথোচিত শাস্তি দেন। কিন্তু যখন শুনেছেন তাঁর স্বামী অর্জুনকেই সাদরে বরণ করতে চলেছেন তখন জনার ক্ষোভ-দুঃখ তীব্র মাত্রা পেয়েছে।
তিনি সমস্ত পাণ্ডব পক্ষের দুর্বলতার দিকগুলি স্বামীর সামনে তুলে ধরেছেন এবং অর্জুন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অর্জুন হলেন মহাপাতকী। কেননা, খাণ্ডব-দাহনে কৃষ্ণের সহায়তা, কুরুক্ষেত্রে-যুদ্ধে ভীষ্ম নিধনে শিখণ্ডীর সাহায্য লাভ, ছলনার আশ্রয়ে দ্রোণাচার্যের হত্যা সাধন, অন্যায় সমরে কর্ণ–হত্যা— এসবই অর্জুনের কু–কর্মের দৃষ্টান্ত।
স্বামী যখন নিতান্তই অবোধ বালকের মতো অর্জুনের পদলেহনের জন্যে উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন, তখন শোকে দুঃখে হতাশায় জনা মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন—
“ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;”
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে জনা চরিত্রে মাতৃ-হৃদয়ের অপূর্ব স্নেহের ধারা এবং তার স্নেহ-বাৎসল্যের সঙ্গে বীরাঙ্গনা মূর্তিটির যথাযথ প্রকাশ ঘটেছে।
প্রশ্ন–৬ কুন্তী ও দ্রৌপদী সম্পর্কে জনা কী কী অভিযোগ করেছেন?
কুন্তী সম্পর্কে জনার অভিযোগ—জনা পুত্রশোকে শোকাতুরা। মহাভারতে বিভিন্ন চরিত্রের নিন্দায় তিনি সরব হয়েছিলেন। শোকাকুলা জনার মনে হয়েছিল—
এক॥ ভোজ রাজ কন্যা কুন্তী ‘স্বৈরিণী‘।
দুই॥ অর্জুন তাঁর ‘জারজ‘ সন্তান।
তিন৷৷ কুমারী অবস্থাতেই তিনি সন্তান গ্রহণ করেছিলেন।
চার।। জনার চোখে কুস্তী ‘কুলটা‘।
দ্রৌপদী সম্পর্কে জনার অভিযোগ—অর্জুন-পত্নী দ্রৌপদীকে নিয়ে জনার বিরক্তির কারণ ছিল। তিনি দ্রৌপদী সম্পর্কে বলেছেন—
এক৷৷ দ্রৌপদী ভ্রমরের মধ্যে মক্ষীরানির মতো।
দুই ।। তিনি রবির অধীনী।
তিন ৷৷ তিনি সমীরণ-প্রিয়া।
চার।। তিনি পৌরব-সরসে নলিনী।
সুতরাং জনার চোখে দ্রৌপদী হলেন ‘ভ্রষ্টা’ রমণী।
প্রশ্ন–৭ কৌরববংশের বিরুদ্ধে জনার অভিযোগগুলি সংক্ষেপে লেখো।
নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকাব্যে পৌরাণিক জনা চরিত্রটিকে কবি শ্রীমধুসূদন নবরূপ দান করেছেন। একমাত্র পুত্র প্রবীরকে হারিয়েছেন জনা। অথচ মাহেশ্বরপুরী–রাজ নীলধ্বজ পুত্রশোকে বিহ্বল নন। বরং অর্জুন ও কৃষ্ণকে নিয়েই তিনি ব্যস্ত। বিরক্ত, অসহায়া জনা তার সমস্ত ক্ষোভ-বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে।
কৌরববংশের বিরুদ্ধে জনার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। প্রথমেই তার অভিযোগ পার্থের বিরুদ্ধে। জনার মনে হয়েছে, কর্ণ ও পিতামহ ভীষ্মকে অন্যায় সমরে নিধনকারী অর্জুন কখনও ক্ষত্রপতি বীরশ্রেষ্ঠ নয়। তাঁকে ‘নরনারায়ণ জ্ঞানে’ পূজা করা অর্থহীন। জনা একই সঙ্গে জানিয়েছেন খাণ্ডব দহন করার মধ্যে অর্জুনের কোনো একক কৃতিত্ব নেই। উপরন্তু যে আচার্য তাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তাকেও ছলনায় হত্যা করেছে। জনার মন্তব্য—
“দ্রোণাচার্য গুরু—
কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,”
অর্জুনের বীরত্বে জনার কোনও বিশ্বাসও নেই। প্রশ্ন তুলেছেন যুদ্ধের রীতি নিয়ে—
“কহ মোরে শুনি,
মহারথী-প্রথা কি হে এই, মহারথি?”
কুন্তীকে জনা চিহ্নিত করেছে ‘স্বৈরিণী’ রূপে। আর তার পুত্রবধূ দ্রৌপদীকে চিহ্নিত করেছেন ‘পৌরব-সরসে নলিনী’ রূপে। দ্বৈপায়ন ঋষি ব্যাস কীভাবেই বা ভ্রাতৃবধূদ্বয়ের সন্তানের জনক হয়েছিলেন; সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে জনা।
কৌরবদের প্রতিটি ঘটনা জনার চোখে লজ্জাকর, হীনকর বলেই মনে হয়েছে। জনা প্রশ্ন করেছে, কুলটা নারী কুন্তীর সন্তান ছিল অর্জুন।
মধুসূদন চেয়েছিলেন, ভারতীয় পুরাণকে নতুন আলোক–সম্পাতে উপস্থাপন করতে।
প্রশ্ন–৮ ‘ভুলিব এ জ্বালা, এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে।‘ – কে, কাকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলেছেন? এখানে কোন জ্বালার কথা বলা হয়েছে? তিনি কীভাবে সেই বিষম জ্বালা ভুলতে চেয়েছেন?
১) কে, কাকে—‘বীরাঙ্গনা‘ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা‘ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাহেশ্বরী পুরীর রাজমহিষীর মনের অন্তর্বেদনার পরিচয় দিয়েছেন। জনা নীলধ্বজকে উদ্দেশ্য করে উক্তিটি করেছেন।
২) কোন্ জ্বালা—জনা তার একমাত্র পুত্র প্রবীরের মৃত্যুর জন্যে কষ্ট পেয়েছেন। এখানে জনার বিলাপে সেই জ্বালার কথা উচ্চারিত হয়েছে।
৩) বিষম জ্বালা ভোলার উপায়—অন্যায় সমরে প্রবীরকে হত্যা করেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। মাহেশ্বরী পুরীর যুবরাজ প্রবীর অশ্বমেধের যজ্ঞাশ্ব ধরেছিলেন। সেই অপরাধে পার্থ তাকে হত্যা করেছিলেন। পুত্রশোকে একান্ত অস্থিরা জনা নীলধ্বজকে জানিয়েছিলেন—
“টুট কিরীটির গর্ব আজি রণস্থলে!
খণ্ডমুণ্ড তার আন শূল-দণ্ড-শিরে!
অন্যায় সমরে মূঢ় নাশিল বালকে;
নাশ, মহেষ্বাস, তারে!”
বীরপুত্র প্রবীর মহাবিক্রমে ক্ষাত্রধর্ম পালন করে রণাঙ্গণে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তার জন্যে গর্ব করা উচিত বলে জনা মনে করেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, অন্যায় সমরে যে মূঢ় প্রবীরকে হত্যা করেছেন, তাকে যেন তাঁর স্বামী যোগ্য শাস্তি দেন। অর্জুনের শাস্তি প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই জনা তাঁর পুত্র হারানোর যন্ত্রণা ভুলতে চান।
প্রশ্ন–৯ ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা‘ কাব্যাংশে নীলধ্বজের প্রতি জনার যে ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।
জনার ক্রুদ্ধ অভিমানী স্বর—
মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’থেকে নীলধ্বজ ও তার পুত্র প্রবীরের কাহিনি সংগ্রহ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্র কবিতাটি রচনা করেছেন।
জনা চরিত্রটি মূল মহাভারতে নেই। জনার কাহিনি পাওয়া যায় কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারতে। সেখান থেকে জনা চরিত্রটি গ্রহণ করে অশ্বমেধ পর্বের সঙ্গে চরিত্রটিকে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। উনিশ শতকীয় নারী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে জনার মাধ্যমে।
মাহেশ্বরী-পুরীর যুবরাজ প্রবীর অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বটিকে আটক করেছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে অর্জুন প্রবীরকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু পিতা হয়ে রাজা নীলধ্বজ অর্জুনের এই অন্যায়কর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। প্রবীরের মৃত্যুতে নীলধ্বজ উদাসীন হলেও জনার হৃদয় শোক-সন্তাপে বিদীর্ণ হয়েছিল।
স্বামী নীলধ্বজের আচরণে প্রথমে বিস্মিত এবং পরে বিক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন জনা। একদিকে কাপুরুষ স্বামীকে তিরস্কার, অন্যদিকে পুত্র-ঘাতক পাণ্ডবদের প্রতি মর্মান্তিক ব্যঙ্গ এবং সেই সঙ্গে বীরপুত্রের জন্যে মায়ের মর্মভেদী বিলাপ জনা চরিত্রকে স্বাতন্ত্র্য করেছে।
স্বামীর কাপুরুষোচিত ব্যবহারে ক্ষত্রিয়–কন্যা জনা ক্রুদ্ধ হয়ে চিঠিতে লিখেছেন—
“তব সিংহাসনে
বসিছে পুত্রহা রিপু—মিত্রোত্তম এবে!
সেবিছ যতনে তুমি অতিথি-রতনে”।—
‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় জনার ক্রুদ্ধ অভিমানী স্বর এভাবে উচ্চকিত থেকেছে।
জনা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই জানিয়েছেন—
“কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা। গুরুজন তুমি;
পড়িব বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে”।
এভাবে জনার মধ্যে অভিমানবোধ, ক্ষোভ ও মর্মপীড়া লক্ষণীয়।
একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত পাঠ্যের প্রশ্ন উত্তর
দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত পাঠ্যের প্রশ্ন উত্তর