গল্পের সরল অর্থ

সরলার্থ ও শব্দার্থ

প্রাচীনকালে পারসিকদের নগরে কশ্যপ এবং অলিপর্বা নামে দুই ভাই বাস করত। তাদের দুজনের পিতা প্রচুর ধনশালী ছিলেন না। পুত্রদ্বয়ের অবস্থা দেখে তিনি মৃত্যু আসন্নে নিজের ধন-সম্পদকে তাদের দুজনের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিলেন; যার দ্বারা তারা ধন-সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে সমান পারে। অতঃপর কশ্যপ এক ধনবান ব্যক্তির কন্যাকে বিবাহ করল। যার দ্বারা সে শীঘ্রই নগরবাসীদের দ্বারা বণিক শ্রেষ্ঠ ধনীরূপে পরিগণিত হল। নানাবিধ বিলাসে কাল কাটাতে লাগল। প্রভূত ধন থাকায় ঈপ্সিত কোনো বস্তুই আর তার কাছে দুষ্প্রাপ্য রইল না।

            যেমন অলিপর্বা, তার শ্বশুরও তেমনই অল্প ধনের অধিকারী ছিলেন। যার ফলে সে শ্রীহীন কুঁড়েঘরে বাস করতে লাগল৷ নিজে এবং স্ত্রী-সন্তানদের বেশ কষ্টেই প্রতিপালন করতে লাগল । প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় শয্যা ত্যাগ করে সে জ্বালানি কাঠ কাটার জন্য বনে গমন করত। কাঠ কাটার পর তিনটি গাধার পিঠে চাপাত এবং নগরে নিয়ে যেত। সেখানে সেগুলি বিক্রয় করত। সেই প্রাপ্ত অর্থে অলিপর্বা জীবিকা নির্বাহ করত।

তারপর একদিন অলিপর্বা প্রতিদিনের মতো বনে গেল। সেখানে প্রচুর কাঠ কাটল। সেই সময় দূরে আকাশে এঁকেবেঁকে ওঠা ধূলিরাশি তার নয়নগোচর হল। সেখানে দৃষ্টি দিয়ে সে বুঝল ওটা ধূলিজাল। এই স্থানের উদ্দেশ্যে দ্রুতগামী অশ্বে আরোহণ করে আগমনের জন্য এই ধূলি উড়ছে। যেহেতু এই স্থানে রাজকর্মচারীরা চলাফেরা করে না, অতএব অশ্বারোহীগণ দস্যু হওয়ার সম্ভাবনা। তখন সে কোনো একটা গোপন স্থান পেতে চারদিকে তাকাল, যেখানে সে চোরদের বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থাকতে পারে।

কিন্তু চোরদের নিকটে আসতে দেখে সে তাড়াতাড়ি নিকটবর্তী গাছে আরোহণ করল। গাছটির শাখা ছিল বিপুল, এবং গাছটি ঘন পাতায় ঢাকা ছিল – যাতে সেখানে থাকার সময় কেউ তাকে দেখতে না পায়। তার থেকে খুব দূরে নয় এমন স্থানে একটি বিশাল পাহাড় ছিল। যার চূড়া ঋজু, উন্নত এবং মানুষের পক্ষে আরোহণের যোগ্য নয়। তারপর তারা ঘোড়ায় চেপে পর্বতের পাদদেশে এসে নামল। অলিপর্বা তাদের গণনা করে দেখল তারা সংখ্যায় চল্লিশজন। তাদের অশ্বগুলিকে তারা দৃঢ় গুল্ম শাখায় বেঁধে বল্গামোচন করে দিল এবং গলায় ধানের থলে জড়িয়ে দিল। সকলে তারা নিজের নিজের ঘোড়ায় বাঁধা বোঝাগুলি গ্রহণ করল। সেগুলি ভারী রূপা-সোনা ইত্যাদিতে পূর্ণ বলে মনে হল।

অন্য সকলের থেকে একজনকে বিশিষ্ট বলে মনে হল – অলিপর্বা তাকে দলপতি বলে ধরে নিল। সে পর্বতের অগ্রভাগে উপস্থিত হল এবং পড়তে লাগল—

হে স্কন্দরাজ, হে অপহরণের দক্ষ শিক্ষক তোমাকে প্রণাম।

হে দস্যুদেব, অনুগ্রহ করে দরজা খুলুন।

এই পদ্য পাঠ করা মাত্র একটি দ্বার উন্মুক্ত হল। এরফলে গুহার ভিতরে প্রবেশের পথ দেখা গেল। সেই পথে সমস্ত অনুচরদের প্রবেশ করতে দেখে সেই দলপতিও নিজে প্রবেশ করল। দ্বার আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল।

            সেই চোরেরা কিছুক্ষণ গুহার মধ্যে রইল। ততক্ষণ পর্যন্ত অলিপর্বা গাছের শাখাতেই রইল। সে চিন্তা করল যদি আমি গাছ থেকে নেমে গৃহের দিকে যাই এবং সেই চোরেরা গুহা থেকে বের হয়ে আসে, তাহলে আমার প্রাণ সংশয় হবে—এইরকম চিন্তা করে সে সেইখানেই রইল। তারপর কিছু সময় পরে দ্বার খুলে গেল। সেখান থেকে প্রথমে দলপতি বের হল। দ্বার দেশে থেকে সে সকল অনুচরকে বের হতে দেখল। তারপর এই পদ্য পাঠ করতে লাগল—

হে স্কন্দরাজ, হে অপহরণের দক্ষ শিক্ষক তোমাকে প্রণাম।

হে দস্যুদেব, অনুগ্রহ করে দরজা বন্ধ করুন।

এই পদ্য পাঠ করা মাত্র গুহাদ্বার আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। পূর্বের মতোই এই পদ্যও অলিপর্বা কান খাড়া করে শুনে নিল এবং নীরবে বার বার আবৃত্তি করে কণ্ঠগত করে নিল।

            এরপর সব চোর নিজের নিজের অশ্বে চড়ে চলে গেল। অলিপর্বা নিজের স্থান ত্যাগ করল না। সে আশঙ্কা করল – যদি এখনই এখান থেকে বের হই, আমার বের হওয়ার পূর্বেই কেনো কিছু ভুলে কিছু নিতে যদি কোনো চোর ফিরে আসে, দেখা মাত্র সে আমাকে বেঁধে ফেলবে।

            সে চিন্তা করল– আমার ওই পদ্য পাঠ করে এই দ্বার খোলা কি – উচিত হবে? যা হোক দেখি। তারপর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। এইরূপ চিন্তা করে সে গাছ থেকে নেমে যখন গুল্মের মধ্য দিয়ে পর্বতের মুখের কাছে গেল এবং পদ্যটি পাঠ করল—

হে স্কন্দরাজ, হে অপহরণের দক্ষ শিক্ষক তোমাকে প্রণাম।

হে দস্যুদেব, অনুগ্রহ করে দরজা খুলুন।

এই বলা মাত্র দ্বার খুলে গেল।

            গুহার ভিতরে প্রবেশ করে অলিপর্বা সর্বত্র প্রচুর ভক্ষ্যদ্রব্য, মহামূল্য রেশমি বস্ত্র, সোনা এবং রূপার মোটা মোটা বাট দেখতে পেল। তারপর সে স্বর্ণপূর্ণ কয়েকটি চামড়ার থলি গ্রহণ করল, যতটুকু তার গর্দভ বহন করতে সমর্থ হবে। সেগুলিকে সে টেনে গুহার দ্বারদেশে আনল। এরপর মন্ত্রের দ্বারা দ্বার মুক্ত করে থলিগুলিকে গাধার পিঠে চাপিয়ে কাঠ দিয়ে ঢেকে দিল। তারপর সে বন্ধ করার মন্ত্র আবৃত্তি করল। দ্বারও সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর সে তাড়াতাড়ি পা ফেলে নগরে পৌঁছোল।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত