বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাংলা অলংকারের মধ্যে পার্থক্য

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাংলা অলংকারের মধ্যে পার্থক্য

একটি অলংকারের সঙ্গে অন্য অলংকারের তুলনামুলক আলোচনা করলে অলংকারকে সঠিকভাবে জানা যায়। পার্থক্য জানা গেলে একটি অলংকারের প্রকৃত পরিচয় ও স্বরূপ সম্বন্ধে বুঝে ফেলা যায়। অনেকসময় দেখা যায়, বিভিন্ন লংকারের মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে অলংকার নির্ণয়ে দ্বিধা শুরু হয়, অনেক সময় আমরা ভুল অলংকার চিহ্নিত করি। তাই একটি অলংকারের সঙ্গে সমপর্যায়ের অলংকারের পার্থক্য জেনে নেওয়া দরকার। এই পোষ্টে মোটামুটি সমস্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি অলংকারের পার্থক্য তুলে ধরা হবে।

(ads1)

পয়েন্ট(toc)

——————————————-

যুক্ত হয়ে যান আমাদের 

👇👇👇

টেলিগ্রাম 

ফেসবুক -এ

——————————————-

অনুপ্রাস ও যমক অলংকারের মধ্যে পার্থক্য

অনুপ্রাস ও যমক দুটিই শব্দালংকার। একটি বর্ণ (বা একটি শব্দ) বার বার ব্যবহৃত হয়ে যে ধ্বনিসাম্য বা শব্দসাম্য সৃষ্টি করে তাকে বলে অনুপ্রাস। যেমন—

কোথা হা হন্ত চির বসন্ত আমি বসন্তে মরি।

এখানে হন্ত/সন্ত এই গুচ্ছ বর্ণটি বারবার (একাধিকক্রমে ২/৩ বার) ব্যবহৃত হয়ে যে ধ্বনিসাম্য সৃষ্টি করছে, তাই অনুপ্রাস।

কিন্তু একটি শব্দ যদি দুবার বা বারবার পৃথক পৃথক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তবে তা হবে যমক। যেমন—

কোথা হা হস্ত চির বসন্ত আমি বসন্তে মরি।

এখানে ‘বসন্ত’ শব্দটি দুবার বসেছে। কিন্তু দুরকম অর্থে বসেছে। প্রথম ‘বসন্ত’ মানে = বসন্ত কাল (ঋতু অর্থে) দ্বিতীয় ‘বসন্ত’ মানে = বসন্ত নামক ছোঁয়াচে রোগ। সুতরাং এখানে একই শব্দ দুবার দু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে এই চরণটি যমক হয়েছে।

সুতরাং অনুপ্রাস ও যমক একই শ্রেণীর অলংকার হলেও দুটি একই অলংকার নয়— এ দুয়ের পার্থক্য সাংঘাতিক

  • ১. অনুপ্রাসে যে বর্ণ বা যে শব্দ বার বার আবৃত্ত হয় (‘বসন্ত’) তার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয় না, (সর্বদা ও সর্বত্র একই অর্থ হয়।) অথবা অর্থের দরকার হয় না। শুনতে তা ঝংকার সৃষ্টি করেই নিঃশেষ হয়। কিন্তু যমকে একটি শব্দ দুবার বসলে দুরকম অর্থ হয় এবং অর্থ ছাড়া তার কোনো মূল্য স্বীকৃত হবে না। অন্য কথায় অনুপ্রাসে শব্দটি নাচতে নাচতে একই কথা বলতে বলতে যায়। কিন্তু যমকে শব্দটি নাচের প্রতিটি তালে অর্থ বদলে বদলে যায়। 
  • ২. একটি মাত্র বর্ণে অনুপ্রাস হবে, কিন্তু একটি মাত্র বর্ণে যমক হবে না। কারণ সাধারণতঃ একটিমাত্র বর্ণে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ পাওয়া দুষ্কর।

অন্য উদাহরণ :

ভারত আমার ভারত আমার যেখানে মানব মেলিল নেত্র।

(অনুপ্রাস = ভারত = ভারতবর্ষ, ভারত = ভারতবর্ষ)

ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে।

(যমক = ভারত = ভারতবর্ষ, ভারত = কবি ভারতচন্দ্র।)

সন্দেহ ও উৎপ্রেক্ষা অলংকারের পার্থক্য

সন্দেহ ও উৎপ্রেক্ষা দুটিই সাদৃশ্যমূলক অর্থালংকার।

যে অলংকারে উপমেয় ও উপমান—দুটিতেই সমান সংশয় থাকে, তাকে সন্দেহ অলংকার বলে। যেমন—

দুই ধারে একি প্রাসাদের সারি? অথবা তরুর মূল?

এখানে,

উপমেয় = প্রাসাদের সারি

উপমান =তরুর মূল

সংশয়সূচক শব্দ = কি,

–এখানে উপমেয় ও উপমান দুটিতেই সমান সংশয়। কবি বুঝতে পারেন না কোন্‌টি প্রকৃত জিনিস? ‘প্রাসাদের সারি’? না ‘তরুর মূল’? এইভাবে দুটিতেই সমান সংশয় বলে কাব্যাংশটি সন্দেহ অলংকার।

অন্যদিকে প্রবল সাদৃশ্যের জন্যে যদি উপমেয়কে উপমান বলে প্রবল সংশয় জাগে, তবে উৎপ্রেক্ষা অলংকার হয়। যেমন–

দুই ধারে দেখি প্রাসাদের সারি যেন সে তরুর মূল।

এখানে,

উপমেয় = প্রাসাদের সারি

উপমান = তরুর মূল

সংশয়সূচক শব্দ = যেন

—এখানে ‘প্রাসাদের সারি’ ও ‘তরুর মূলে’ প্রবল সাদৃশ্য। তাই কবির মনে হয়েছে প্রাসাদের সারিটি ঠিক তরুর মূলের মতো। এখানে উপমেয় ‘প্রাসাদের সারি’কে পেছনে ফেলে ‘তরুর মূল’ই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।

সুতরাং সন্দেহ ও উৎপ্রেক্ষা একই শ্রেণীর সাদৃশ্যমূলক অলংকার হলেও এ দুটি একই অলংকার নয়—দুটিতে অনেক পার্থক্য আছে : 

১. সন্দেহ ও উৎপ্রেক্ষা দুটিতেই সংশয় মুখ্য বস্তু—

(ক) সন্দেহে উপমেয় উপমান দুটিতে সমান সংশয়—কোন্‌টি প্রকৃত বস্তু আর কোন্‌টি অপ্রকৃত বস্তু সেইটি ধরা সহজ নয় অর্থাৎ কে উপমেয় (প্রকৃতবস্তু) আর কে উপমান তা নিয়েই সংশয়।

(খ) কিন্তু উৎপ্রেক্ষায় উপমেয়কে উপমান বলে সংশয় জাগে—তাতে উপমেয়কে পিছনে রেখে উপমানই সামনে এসে দাঁড়ায় অর্থাৎ উপমানই সত্য বলে মনে হয়।

২. সন্দেহে সংশয় ব্যক্ত হয় কবি কল্পনার চমৎকারিত্নে। অন্যদিকে উৎপ্রেক্ষায় কবি কল্পনার চমৎকারিত্বই সংশয় সৃষ্টি করে। 

৩. সন্দেহে সংশয়সূচক শব্দ হলো = কি, কিম্বা, অথবা, না, নাকি। অপরদিকে উৎপ্রেক্ষায় সংশয়সূচক শব্দ = যেন, জনু, বুঝি, মনে হয়, মনে গণি, প্রায় ইত্যাদি।

উৎপ্রেক্ষা ও অপহ্নুতি অলংকারের পার্থক্য

উৎপ্রেক্ষা ও অপহ্নুতি দুটিই সাদৃশ্যমূলক অলংকার। কিন্তু দুটি একই অলংকার নয়।

প্রবল সাদৃশ্যের জন্য উপমেয়কে উপমান বলে যদি প্রবল সংশয় জাগে তবে উৎপ্রেক্ষা অলংকার হয়। যেমন—

পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

 —এখানে,

উপমেয় = পূর্ণিমা চাঁদ

উপমান = ঝলসানো রুটি

সংশয় বাচক শব্দ = যেন

চাদ ও রুটিতে প্রবল সাদৃশ্যের কারণ—দুটিই গোলাকার ও ঝলমলে। তাই চাঁদকে রুটি বলে সংশয় জাগছে। ‘যেন’ শব্দের ব্যবহারে সেই সংশয় বোঝা যাচ্ছে। এই যে উপমেয়-উপমানে প্রবল সাদৃশ্য এবং সাদৃশ্যের জন্যেই প্রবল সংশয় – তাতেই এটি উৎপ্রেক্ষা অলংকার হয়েছে।

অপরপক্ষে যেখানে উপমেয়কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে উপমানকে স্বীকার বা প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানেই অপহৃতি অলংকার হয়। যেমন—

পূর্ণিমা চাঁদ নয়তো বন্ধু ও যে ঝলসানো রুটি।

—এখানে,

উপমেয় = পূর্ণিমা চাঁদ

উপমান = ঝলসানো রুটি

অস্বীকারবাচক শব্দ = নয়

কিন্তু এখানে উপমেয় ও উপমানে কোনো সংশয় নেই এবং উপমেয়কে (চাঁদকে) ফেলে বা অস্বীকার করে উপমান (রুটি) প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অর্থাৎ বন্ধু তুমি দে তা পূর্ণিমা চাঁদ নয়, তা ঝলসানো রুটি। সুতরাং,

১. উৎপ্রেক্ষাতে উপমেয়কে উপমান বলে প্রবল সংশয় জাগবে কিন্তু উপমেয়কে পিছনে রেখে উপমান সামনে এসে দাঁড়াবে না। অপরদিকে অপহ্নুতিতে উপমেয়কে পিছনে ফেলে উপমানই প্রধান রূপে সামনে দাঁড়াবে।

২. উৎপ্রেক্ষাতে সংশয় বাচক শব্দ থাকে— যেন, জনু, বুঝি, মনে হয়, মনে গণি, প্রায় ইত্যাদি। অপরদিকে অপহৃতিতে অস্বীকার সূচক শব্দ থাকে — না, নহে, নাই, নয়, নতুবা, ছল, ছলনা, ছদ্ম, ব্যাজ প্রভৃতি।

অতিশয়োক্তি ও ব্যতিরেক অলংকারের পার্থক্য

অতিশয়োক্তি ও ব্যতিরেক দুটিই সাদৃশ্যমূলক অর্থালংকার। কিন্তু দুটি অভিন্ন অলংকার  নয়।

উপমেয় ও উপমানে অভেদত্বের জন্যে যদি উপমান উপমেয়কে সম্পূর্ণ গ্রাস করে এবং নয় উপমানই উপমেয় বলে প্রতিপন্ন হয়, তবে তাকে অতিশয়োক্তি অলংকার বলে। যেমন—

সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়

তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।

এখানে,

উপমান = সাগর, অগ্নি

উপমেয় = কোনো উল্লেখ নেই। তবে সত্যেন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর প্রশস্তি বিষয়ক এই কবিতাংশটিতে উপমেয় হবে বিদ্যাসাগর ও তাঁর মনের তেজ।

এখানে উপমান উপমেয়টিকে সম্পূর্ণ রূপে গ্রাস করেছে এবং উপমানই উপমেয় বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। তাই এটি অতিশয়োক্তি অলংকার।

অপরপক্ষে যেখানে উপমেয়কেই উপমান অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট করে দেখানো হয়, তাকে ব্যতিরেক অলংকার বলে। যেমন—

কলকল্লোলে লাজ দিল আজ নারী কণ্ঠের কাকলি।

এখানে,

উপমেয় = নারী কন্ঠের কাকলি 

উপমান = কলকল্লোল (= হট্টগোল)

কবি বলেছেন এই নারী কণ্ঠের কাকলি কলকল্লোলকে লজ্জা দিল; মানে নারী কণ্ঠধ্বনি কলকল্লোল থেকেও উচ্চগ্রামে পৌঁছেছে। কলকল্লোলই নিন্দার বস্তু, তার থেকে উচ্চগ্রামে পৌঁছানোর জন্য নারী কণ্ঠ কাকলি অধিক নিন্দার বস্তু হল বা নিকৃষ্ট বলে সূচিত হলো। তাই এ হল ব্যতিরেক।

সুতারাং,

অতিশয়োক্তিতে উপমান উপমেয়কে গ্রাস করে,উপমানই উপমেয় বলে প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু ব্যতিরেকে — উপমান অপেক্ষা উপমেয়কে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট করে দেখান হয়

[চলবে]

আমাদের টেলিগ্রাম ও ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হোন

👇👇👇👇

Join Telegram (demo)

Join Facebook (open)

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত