[] লর্ড ডালহৌসির (১৮৪৮-৫৬ খ্রি.) আমলে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানি’ ভারতে সর্বপ্রথম রেলপথের প্রতিষ্ঠা করে। ডালহৌসিকে ‘ভারতীয় রেলপথের জনক’ বলা হয়। তাঁর আমলে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ২১ মাইল পথে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এবং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ভারতের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইল পথে ভারতের দ্বিতীয় রেলপথ চালু হয়।
।। রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য ।।
ভারতে রেলপথ স্থাপনের পিছনে ইংরেজদের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী ও শোষণমূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। মূলত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যেই ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
[১] কাঁচামাল রপ্তানি সহজ করা = ভারতের অভ্যন্তর থেকে কাঁচামাল দ্রুত বন্দরে পৌঁছোনোর উদ্দেশ্যে রেল যোগাযোগের প্রয়োজন হয়।
[২] বিলাতি পণ্যের আমদানি সহজ করা = ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে সেখানকার কারখানাগুলিতে প্রচুর পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে। এসব সামগ্রী ভারতের অভ্যন্তরে দূরদূরান্তের বাজারগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে।
[৩] রাজনৈতিক উদ্দেশ্য = বিশাল ভারতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত সংবাদ আদানপ্রদান ও যোগাযোগ রক্ষা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ, সেনাবাহিনীর কাছে দ্রুত খাদ্য ও রসদ পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ভারতে রেলপথ স্থাপনকে ব্রিটিশ সরকার অপরিহার্য বলে মনে করে।
[৪] সামরিক প্রয়োজনে = ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সামরিক প্রয়োজনে ভারতে রেলপথ নির্মাণের গুরুত্ব ভালোরকম উপলব্ধি করে। তাই দেখা যায়, বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল না—এমন বহু স্থানে শুধু সামরিক প্রয়োজনে রেলপথ স্থাপিত হয়।
[৫] দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা = ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে দুর্ভিক্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা। দুর্ভিক্ষকবলিত এলাকায় দ্রুত খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছোনোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার রেল যোগাযোগের প্রয়োজন উপলব্ধি করে।
।। ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ ।।
ব্রিটিশদের সময়কালে ভারতে রেলপথের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে চারটি পৃথক পর্যায় লক্ষ করা যায়। যথা—গ্যারান্টি ব্যবস্থা, সরকারি উদ্যোগ, পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা এবং পুনরায় সরকারি উদ্যোগ। এই পর্যায়গুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল—
[১] গ্যারান্টি ব্যবস্থা = রেলপথ নির্মাণে কোম্পানিগুলিকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোম্পানিগুলিকে সরকার কয়েকটি বিষয়ে ‘গ্যারান্টি’ বা প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থা’য় বলা হয় যে,
[i] সরকার কোম্পানিগুলিকে রেলপথ নির্মাণের জন্য বিনামূল্যে জমি দেবে।
[II] কোম্পানিগুলির বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দেবে।
[iii] সুদ পরিশোধের পর লভ্যাংশ সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে।
[iv] ২৫ বা ৫০ বছর পর সরকার ইচ্ছা করলে রেলপথগুলি ক্রয় করতে পারবে।
ক্রমে কোম্পানিগুলি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোম্পানিগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করতে থাকে এবং তাদের বার্ষিক হিসেবে প্রচুর ঘাটতি দেখায়। ভারতের রাজস্ব থেকে এই ঘাটতি মেটানো হত।
[২] সরকারি উদ্যোগ = ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থায়’ নানা সমস্যা দেখা দিলে সরকার এই ব্যবস্থা বাতিল করে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। সরকারি উদ্যোগে ১৮৬৯ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেশ কিছু রেলপথ নির্মিত হয়। সরকারি উদ্যোগে রেলপথ নির্মাণের ফলে কোম্পানিগুলির মুনাফা লাভের পথ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ও দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের ফলে ভারত সরকারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে রেলপথ নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।
[৩] পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা = সরকারি পরিচালনায় রেলপথ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রেলপথ নির্মাণে পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু রেলপথ নির্মাণ পরিকল্পনার দায়িত্ব থাকে সরকারের হাতে। এইসময় রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য ‘রেল বোর্ড’ এবং ‘অ্যাকওয়ার্থ কমিটি’ গঠিত হয়েছিল।
[৪] পুনরায় সরকারি উদ্যোগ = প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ রেল ব্যবস্থায় বেসরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার কয়েকটি রেল কোম্পানির দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করে। রেলের বাজেট দেশের সাধারণ বাজেট থেকে পৃথক করা হয়।