কর্নওয়ালিশের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার পরিচয় দাও। [বা], চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপর সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লেখ।

[] বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশ দিয়ে কর্নওয়ালিশকে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাঠান। কর্নওয়ালিশ বড়োলাট হয়ে ভারতে আসেন ১৭৮৬ খ্রি.।

[] শোর-গ্রান্ট বিতর্ক : কর্নওয়ালিশ ভারতে জমির বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনা শুরু করলে পরস্পরবিরোধী দুটি অভিমতের সৃষ্টি হয়। (১) রাজস্ব বিভাগের প্রধান জন শোর বলেন যে, মোগল আমলে জমিদাররাই ছিল জমির মালিক। তাই জমিদারদের সঙ্গেই সরকারের জমি বন্দোবস্ত করা উচিত। (২) কোম্পানির দলিল বিভাগের প্রধান জেমস গ্রান্ট বলেন যে, মোগল আমলে জমির প্রকৃত মালিক ছিল সরকার, জমিদার ছিলেন রাজস্ব সংগ্রাহক মাত্র। তাই সরকারের উচিত সরাসরি কৃষকের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করা।

দশসালা বন্দোবস্ত

লর্ড কর্নওয়ালিশ নিজে ছিলেন ইংল্যান্ডের বড়ো জমিদার। তাই জন শোরের কিছু অভিমত তাঁকে আকৃষ্ট করে। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর তিনি ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও বিহারের এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের কথা ঘোষণা করেন। এই ব্যবস্থা ইতিহাসে ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

কর্নওয়ালিশ দশসালা বন্দোবস্তকে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করেন। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থায় বলা হয়—

(১) জমিদাররা বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগদখল করতে পারবেন।

(২) জমিদার ইচ্ছামতো জমি দান, বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারবেন।

(৩) সূর্যাস্ত আইন অনুসারে জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারের প্রাণ্য রাজস্ব পরিশোধ করবে এবং অন্যথায় জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে।

(৪) খরা, বন্যা, মহামারি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মকুব হবে না।

ফলাফল

বাংলার ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই ব্যবস্থা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ভূমি ও সমাজ—উভয়ক্ষেত্রেই এক বিরাট পরিবর্তন আনে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফলগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল—

[] সুফল—() চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং সরকারের রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। () রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদেরও সুবিধা হয়। () জমিদাররা জমি ও কৃষির উন্নতিতে যত্নবান হন। () চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সরকারের অনুগত একটি জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।

[] কুফল—() জমিদার বেশি রাজস্ব পাওয়ার আশায় চাষিকে ঘনঘন জমি থেকে উৎখাত করত। () চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারের ভাড়াটে মজুরে পরিণত হয়।     () জমিদাররা কৃষকদের ওপর প্রবল অত্যাচার চালিয়ে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করার ফলে কৃষকদের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে ওঠে। () এই ব্যবস্থায় ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুসারে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারি কোশাগারে রাজস্ব জমা দিতে না পারায় পুরোনো বহু জমিদার তাঁদের জমিদারি হারান। () পুরোনো বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারালে শহুরে ধনী বণিকরা নিলামে এই জমিদারিগুলি কিনে নেন। এসব ভূঁইফোড় নতুন জমিদাররা শহরে বসে তাঁদের নায়েব-গোমস্তাদের দিয়ে জমিদারি চালাতেন। ()  জমিদার ও চাষির মাঝখানে পত্তনিদার, দর-পত্তনিদার প্রভৃতি স্তরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির  উত্থান ঘটে। তাদের সীমাহীন আর্থিক শোষণ কৃষিকাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।

[] মূল্যায়ন—চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে একদিকে নব্য জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী প্রভৃতি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে, অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষক ও কারিগররা ভূমিহীন মজুরে পরিণত হয়। এভাবে গ্রাম সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির ঐতিহ্যগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে যায়।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত