দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ [মান = ২]

০১— দামিন-ই-কোহ বলতে কী বোঝ ?

[] ‘দামিন-ই-কোহ’ কথার অর্থ হলো ‘পাহাড়ের প্রান্তদেশ’

[] সাঁওতালরা  রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশের জঙ্গলপুর্ণ অঞ্চল পরিষ্কার করে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করে তুলেছিল। সেই অঞ্চল ‘দামিন-ই-কোহ’ নামে পরিচিত ছিল।

০২—সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব লেখ

[] ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

[] গুরুত্ব : ক. ব্রিটিশরা সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগণা গঠন করে।

খ. সাঁওতালদের এলাকায় দিকুদের বসবাস নিষিদ্ধ করে দেয়। পাশাপাশি মহাজনদের সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেয়।

০৩—তিতুমির বিখ্যাত কেন ?

[] তিতুমির ছিলেন বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা। তাঁর প্রকৃত নাম মির নিশার আলি।

[] তিতুমির বাংলায় জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করেন। তিনি ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বিদ্রোহ ‘বারাসাত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

০৪—তরিকা-ই-মহম্মদীয়া কী ?

[] ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ কথার অর্থ হল হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ

[] আরবে আব্দুল ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর প্রবর্তিত আন্দোলন ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। এই আন্দোলনের প্রকৃত নাম ছিল ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’।

০৫—ফরাজি আন্দোলন বলতে কী বোঝ ?

[] ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ‘আল্লাহর আদেশ’।

[] উনিশ শতকে ভারতে মুসলমানদের মাধ্যামে ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবন নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা বাংলাদেশে ‘ফরাজি আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ এই আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন।

০৬—ফরাজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল ?

[] উদ্দেশ্য : ক. ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করা।

খ. ইংরেজ শাসক তাড়িয়ে বাংলায় ইসলামের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

গ. আদর্শ মুসলিম সমাজ গড়ে তোলা।

০৭—দার-উল-হারব এবং দার-উল-ইসলাম বলতে কী বোঝ?

দার-উল-হারব –এর অর্থ হল ‘শত্রুর দেশ’। ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা ইংরেজ শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ বলে অভিহিত করত।

‘দার-উল-ইসলাম’ কথার অর্থ ‘ইসলামের দেশ’। ওয়াহাবিরা বিধর্মী ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল। এইভাবে তারা ইসলামের দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।

০৮—খেরওয়ারি হুল কী ?

ভারতে ইংরেজ কোম্পানি শাসনের প্রথম শতকে যে উপজতি বিদ্রোহ হয়েছিল তাদের মধ্যে ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল অন্যতম। সাঁওতালি ভাষায় এই বিদ্রোহ ‘খেরওয়ারি হুল’ নামে পরিচিত ছিল।

০৯—চূয়াড়দের বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

[] ১৭৯৮-৯৯ সালে চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

[] এই বিদ্রোহের কারণ ছিল—১. উচ্চহারে কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হত। ২. সূর্যাস্ত আইনের দ্বারা অনেক জমিদার ‘জমিদারি’ হারিয়েছিল। এই কারণে তাঁরা বিদ্রোহ করেছিল।

১০—কোলরা কেন বিদ্রোহ করেছিল?

[] ১৮৩১-৩২ সালে কোল বিদ্রোহের সূচনা হয়।

[] এই বিদ্রোহের কারণ ছিল—১. কোলদের উপর অতিরিক্ত রাজস্বের হার চাপানো। ২. কোলদের উপর ব্রিটিশ আইন প্রয়োগ করা হলে কোলরা ক্ষুব্ধ হয়।

১১—সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের চরিত্র কীরূপ ছিল?

[] ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল প্রথম  কৃষক বিদ্রোহ।

[] একে কৃষক বিদ্রোহ বলা হলেও ব্রিটিশরা এই বিদ্রোহকে বিভিন্নভাবে অভিহিত করে। ব্রিটিশরা এই বিদ্রোহকে ‘হিন্দুস্থানের যাযাবার, পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব বলে অভিহিত করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল কৃষক শ্রেণির বিদ্রোহ।

১২—কবে কোথায় কিভাবে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল?

[] অষ্টাদশ শতকে আরব দেশে আবদুল ওয়াহাবের  নেতৃত্বে ইসলাম ধর্মের যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, তা অয়াহাবি আন্দোলন নামে অভিহিত হয়।

[] ভারতের এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমেদ। বাংলায় এই আন্দোলন করেন তিতুমির।

১৩—নীলচাষিরা কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জানিয়েছিল?

নীলকরদের অকথ্য অত্যাচার এবং নীলচাষে বাধ্য করানোতে ক্ষুব্ধ চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। বিভিন্ন নেতাদের উদ্যোগে চাষিরা গণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

১৪—ফরাজি আন্দোলন কি ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আন্দোলন?

[] ফরাজি কথাটির অর্থ হলো—অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ভারতের মুস্লমানদেরর মধ্যে এই আন্দোলন সংঘটিত হয়। প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলন ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করার লক্ষ্যে শুরু হয়। পরে তা কৃষক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

১৫—নীলকররা কিভাবে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার করত?

[] নীলচাষে কৃষক অবাধ্য হলে তাকে মারধোর করা হত।

[] অবাধ্য চাষির গোরু-বাছুর নীলকুঠিতে আটকে রাখা হত।

[] নীলচাষের জন্য জমির মাপে কারচুপি করা হত।

[] দাদন দেওয়ার জন্য চাষিদের জোর করে নীলকরদের কাছেই নীল বক্রি করতে বাধ্য করতো।

১৬—দুদু মিঞা স্মরণীয় কেন?

[] দুদু মিঞা ‘ফরাজি আন্দোলনে’র একজন নেতা। হাজি শরিয়ৎউল্লার পুত্র। দুদু মিঞার প্রকৃত নাম—মহম্মদ মহসিন।

[] দুদু মিঞার নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন আরো জোরদার হয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল—জমিদারি ও বিদেশি শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর সময়ে এই আন্দোলন ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। 

১৭—নীলবিদ্রোহে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা কী? অথবা নীলবিদ্রোহে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার ভূমিকা লেখ?

[] নীল বিদ্রোহে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ।

[] এই ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নীলচাষিদের দুর্দশা ও নীলকরদের অত্যাচারের কথা প্রকাশ পেত। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে নীল বিদ্রোহের খবর বাংলার শিক্ষিত জনগণের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল।

১৮—সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হলো কেন?

[] সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল বিভিন্ন কারণে—

১. সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও আত্মকলহ বিদ্রোহীদের দুর্বল করে দিয়েছিল। ২. যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। ৩. সাংগঠনিক দুর্বলতা। ৪. যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা প্রভৃতি। 

১৯—নীলবিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা লেখ।

নীলবিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভুমিকা প্রসঙ্গে যাঁর কথা প্রথমেই মনে আসে তিনি হলে রেভারেন্ড জেমস লঙ। তিনি উদ্যোগ নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর কারাবাস ও জমিরানাও হয়েছিল এই জন্যে। কিন্তু তিনি এইভাবেই নীলচাষিদের পক্ষে সরব হয়েছিলেন। 

২০—চূয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্ব লেখ।

[] চূয়াড় বিদ্রোহ প্রভাবিত এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় ‘জঙ্গলমহল’ জেলা। [] নামমাত্র খাজনায় চূয়াড়দের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয় বড়িটিশরা।

২১—বিদ্রোহ বলতে কী বোঝায়?

প্রচলিত কোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বিরোধিতা জানালে, তাকে বিদ্রোহ বলা হয়। এই ধরণের প্রতিবাদ একক বা সমষ্টিগত হতে পারে, আবার সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণ হতে পারে। কোল বা সাঁওতালদের প্রতিবাদ হলো বিদ্রোহ।

২২—অভ্যুত্থান কী?

সশস্ত্র সমষ্টিগত বিদ্রোহ হলো অভ্যুত্থান। সিপাহি বিদ্রোহ একটি অভ্যুত্থান ছিল।

২৩—বিপ্লব কী?

প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হলে তাকে বিপ্লব বলা হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।  যেমন—ফরাসি বিপ্লব।

২৪—সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি কীরূপ ছিল?

সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধুমাত্র উপজাতি বিদ্রোহ ছিল না, এই বিদ্রোহ ছিল—ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবীদের মিলিত প্রতিবাদ। স্থানীয় কুমোর, ডোম, কামার। গোয়ালা, তাঁতি, চামার প্রভৃতি পেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেছিল। এককথায় এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষের মিলিত প্রতিবাদ।

২৫—মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব লেখ।

[] গুরুত্ব—১। মুন্ডাদের ‘খুৎকাঠি’ প্রথা ব্রিটিশরা মেনে নেয়।   খ। বেগারপ্রথা ও জমি থেকে উচ্ছেদ নিষদ্ধ করা হয়।

২৬—বঙ্কিমচন্দ্রের কোন কোন উপন্যাসের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কথা আছে?

[] ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাস দুটিতে।    

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত