‘এমন দুর্যোগে ভগবানও কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোন বোধ করি’—দুর্যোগের বর্ণনা দাও। এমন দিনে ভগবান কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোন বলতে বক্তা কী বুঝিয়েছেন?

[] গল্প পরিচয়—মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। ১৯৮২ সালে গল্পটি ‘ম্যানিফেস্টো’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি মহাশ্বেতা দেবীর ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ বইয়ে সংকলিত হয়েছে। লেখিকা ‘উচ্ছব’ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বাদা অঞ্চলের সমস্ত ভূমিহীন, বঞ্চিত মানুষদের কথা পাঠকদের শুনিয়েছেন।

[] দুর্যোগের বর্ণনা—বাদার অধিবাসী উৎসব নাইয়ার জীবনে এই ‘দুর্যোগের’ রাত ছিল ভয়ংকর একটা রাত। মাতলার নদীর বন্যা উচ্ছবের জীবনকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছিল। এই দুর্যোগের রাতে উচ্ছব ও তার বউ-ছেলে-মেয়ে পেট ভরে খেয়েছিল হিঞ্চে সেদ্ধ, গুগলি-গেঁড়ি।

          এরপর শুরু হয় তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। ছেলে-মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঠান্ডায় আর ভয়ে কাঁপছিল উচ্ছবের বউ, অন্যদিকে উচ্ছব ঘরের মাঝখানের খুঁটিটি শক্ত করে ধরে রেখেছিল। উন্মত্ত মাতলা কখন তার সংসার ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে জানে না।

          বন্যায় উচ্ছবের ভিটেমাটি, পরিবারের সবাই ভেসে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল টিনের কৌটোর মধ্যে রাখা দরখাস্তের নকল, জমি চাওয়ার আবেদনপত্র। সবকিছু হারিয়ে শুধুমাত্র বেঁচে গিয়েছিল একটা গাছে আটকে। নিঃস্ব উচ্ছব পরবর্তী কয়েকটি দিন পাগলের মতো তার হারিয়ে যাওয়া সংসারকে খুঁজে বেড়িয়েছিল। তার মতোই অন্য হতদরিদ্রদের অবস্থা হয়েছিল। প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

[] বক্তার মনোভাব—প্রকৃতির রোষের কাছে অসহায় উচ্ছব ভগবানকে স্মরণ করেছিল—“উচ্ছব বলে চলছিল ভগমান! ভগমান! ভগমান!” দীনদরিদ্র, বঞ্চিত মানুষদের কাছে ঈশ্বরের চেয়ে বড়ো আশ্রয় আর নেই। সেদিন রাতে উচ্ছবের পরিবারকে বাঁচাতে ঈশ্বর এগিয়ে আসেননি। তিনি  যেন উদাসীন ক্ষমতাশালীর মতো কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। ঈশ্বর যেন শুধু ধনীদেরই খেয়াল রাখেন,  হতদরিদ্রদের কাছে তিনি ঘেঁষেন না। উচ্ছব সেই রাতের অসহায়তার প্রসঙ্গে এমন কথা ভেবেছিল। উচ্ছবের ভাবনা যে গল্পলেখকেরই নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ–তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

**—সেই রাতের দুর্যোগ উচ্ছবের জীবনে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল?

[] মাতলা নদীর বন্যায় উচ্ছব নাইয়ার সমস্ত সংসার অর্থাৎ বউ-ছেলে-মেয়ে, বাড়িঘর সমস্ত কিছু ভেসে যায়। বেঁচে যায় শুধু উচ্ছব নিজে। পরদিন সকালে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পরিবারের প্রিয় সদস্যদের খুঁজেছিল উচ্ছব। পাগলের মতো হয়ে উঠেছিল সে। সাধন দাশের উপদেশ উচ্ছব মেনে নিতে পারছিল না। ভূমিহীন উচ্ছবের একমাত্র আশার আলো যে জমি চাওয়ার দরখাস্ত সেটিও টিনের কৌটোর সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল। একরাতের দুর্যোগে উচ্ছব নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল।

          স্ত্রী-পুত্র-কন্যার শোকে সরকারি লঙ্গরখানায় তার খিচুড়ি খাওয়া হয় না। যখন সে শোক সামলে উঠেছিল ততদিনে লঙ্গলখানার খিচুড়ি সব শেষ। এইসব ঘটনার ধাক্কায় সে ভাতের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তার পরিবারের সকলের ভাতের জন্য ব্যাকুলতা ও ভাতের খিদে নিয়ে উচ্ছব চলে এসেছিল শহরে—ভাত উচ্ছব খেয়েছিল, সকলের জন্যও খেয়েছিল।

error: সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত